১৮৫৭ র বিদ্রোহের প্রকৃতি আলোচনা করো।
অথবা,
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ কি একটি জাতীয় সংগ্রাম ছিল তা আলোচনা করো।
১৮৫৭ খ্রিঃ মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে বির্তক রয়েছে। বলা বাহুল্য, আজও এই বিতর্কের নিষ্পত্তি ঘটেনি। মহাবিদ্রোহের এমন ৪টি জায়গা বা দিক রয়েছে, যা নিয়ে এই বিদ্রোহ শুরুর সময় থেকেই ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানা বিভ্রান্তি ও ধোঁয়াশা লক্ষ্য করা যায়। এই ধারনাগত বিভ্রান্তি বা ধোঁয়াশা থেকেই মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে নানা মত ও বিতর্কের সূত্রপাত ঘটেছে।
বিভ্রান্তিকর এই ৪টি দিক হলো-
• মহাবিদ্রোহের ব্যাপকতা ও বিস্তার,
• এই বিদ্রোহের স্থানীয় বা আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা,
• রাজ্য ছাড়া কতিপয় সামন্ত রাজার বিদ্রোহে যোগদান,
• স্বাধীন ভারতের সম্রাট রূপে বিদ্রোহীদের দিল্লীর বাদশাহের নাম ঘোষণা বা ব্যবহার।
কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন, মহাবিদ্রোহ শুধুমাত্র সিপাহীদেরই বিদ্রোহ ছিল। কেউবা আবার এই ৪টি দিককে অন্যভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে দেখাতে চেয়েছেন, মহাবিদ্রোহ একটি জাতীয় সংগ্রাম ছিল অথবা একটি সামন্ত বিদ্রোহ ছিল। মোটকথা, মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত গবেষণার ভিত্তিতে ঐতিহাসিকদের মধ্যে ৩টি প্রধান মত উঠে এসেছে। যথা-
• মহাবিদ্রোহ শুধুমাত্র সিপাহীদের বিদ্রোহ ছিল।
• মহাবিদ্রোহ ছিল একটি সামন্ততান্ত্রিক অভ্যুত্থান।
• মহাবিদ্রোহ ছিল একটি জাতীয় সংগ্রাম। এটি ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল।
> জাতীয় বিদ্রোহ নাকি সিপাহী বিদ্রোহ:
> বিতর্ক: ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের শুরুর সময় থেকেই এটি 'জাতীয় বিদ্রোহ নাকি একটি সামরিক বিদ্রোহ' তা নিয়ে বিতর্ক দেখা যায়। পরবর্তীকালে ১৯৫৭ খ্রিঃ মহাবিদ্রোহের শতবর্ষ উদযাপনের বৎসরে নতুন করে এই বির্তক দানা বাঁধে, আজও এই বিতর্কের নিরসন হয়নি। আসলে বর্তমান সময় কালের আঐতিহাসিকদের মতো মহাবিদ্রোহ, চলাকালীন সময়ের সমসাময়িক তথ্যকার ও বিবরণীকারদের মধ্যেও এই বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা গিয়েছিল। তাই মহাবিদ্রোহের সমসাময়িক সময়ে কেউ এই বিদ্রোহেকে নিছকই একটি 'সিপাহী বিদ্রোহ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। কেউবা আবার একে শুধু সিপাহী বিদ্রোহ হিসাবে না দেখে একে একটি জাতীয় সংগ্রাম হিসাবে দেখেছেন।
- পরস্পর বিরোধী শিবির: স্পষ্টতই মহাবিদ্রোহের প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে
একে জাতীয় সংগ্রাম বলা যায় কিনা, সেই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে পরস্পর বিরোধী। শিবির তৈরি হয়েছে।
একদিকে রয়েছে, সমকালীন সময়ের চার্লস রেকস, জন সিলি, স্যার জন লরেন্স, অক্ষয় কুমার দত্ত, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, সৈয়দ আহমেদ খান, দাদাভাই নৌরজী, জন কে, কিশোরীচাঁদ মিত্র এবং প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্ত, যারা এই বিদ্রোহকে শুধু সিপাহী বিদ্রোহ বলেই দেখানোর চেষ্টা করেছেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কার্লস মার্কস এবং অন্যান্য ঐতিহাসিকদের মধ্যে আছেন- অশোক মেহতা, রনজিৎ গুহ, গৌতমভদ্র, সুপ্রকাশ রায়, সুশোভন সরকার, এরা নানা তথ্য ও যুক্তির সাহায্যে দেখানোর চেষ্টা করেছেন, ১৮৫৭ র বিদ্রোহ নিছক সিপাহী বিদ্রোহ ছিল না। এটি ছিল জনগণের সংগ্রাম এবং যথার্থ অর্থেই একটি 'জাতীয় সংগ্রাম'। বিনায়ক দামোদর সাভারকরই প্রথম মহাবিদ্রোহকে জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চার আওতার মধ্যে নিয়ে আসেন। তিনি ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি নির্ণয় করতে গিয়ে একে 'ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ' বলে আখ্যায়িত করেন।
> জাতীয় সংগ্রামের বিরুদ্ধে মত ও যুক্তি: ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে যারা গবেষণা করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার, টমাস মেটকাফ, রজনীপাম দত্ত। রমেশচন্দ্র মাজুমদারের মতে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ কোন মতেই একটি জাতীয় বিদ্রোহ ছিল না। স্বাধীনতা সংগ্রাম তো ছিলই না।
> ডঃ মজুমদার তার মতের স্বপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন: ডঃ মজুমদার স্বীকার করেছেন, মহাবিদ্রোহের সঙ্গ্যে জনগণের একটা অংশের 'যোগ ছিল। কিন্তু জনসংযোগ ছিল বলেই তিনি এই বিদ্রোহকে 'জাতীয় বিদ্রোহ' বলার পক্ষপাতী নন। তার মতে, সিপাহী বিদ্রোহে অসামরিক জনগণের বিদ্রোহ গুলি ছিল সামরিক বিদ্রোহের প্রতিক্রিয়া মাত্র।
ঐক্যবদ্ধ চেতনা' এবং 'ঐক্যবদ্ধ আদর্শ' যেকোনো দেশের জাতীয়
আন্দোলনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মহাবিদ্রোহে এর একান্তই অভাব ছিলো।
ডঃ মজুমদার তার মতের স্বপক্ষে আরোও একটি যুক্তি তুলে ধরে বলেছেন, বাহাদুর শাহকে যখন বিদ্রোহীরা ভারত সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করে তখন মুঘল সাম্রাজ্য ও মুসলমান শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার আশঙ্কায় শিখ, রাজপুত, মারাঠাও বাঙালি হিন্দুরা এই বিদ্রোহের বিরোধীতা করে। তাদের মনোভাব ও আচরণ কোনোটাই জাতীয় সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না।
সর্বদিক বিচার বিবেচনা করে রমেশচন্দ্র মজুমদার তাই সিদ্ধান্তে এসেছেন ১১৮৫৭র প্রথম জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ'। না ছিল প্রথম, না ছিল জাতীয়, না ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ।
১৮৫৭র সিপাহী বিদ্রোহের মূল কারণ ছিলো অর্থনৈতিক শোষণ ও বৈষম্যমূলক নীতি। জাতীয় সংগ্রামের কোনো মনোভাব এখানে লক্ষ্য করা যায়। নি।
0 Comments