সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণগুলি সংক্ষেপে আলোচনা কর।
বালুরঘাট দক্ষিণ দিনাজপুর নতুন ভাবে তৈরি করা অলোকা।
ভূমিকা:
সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণগুলি সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ কোন ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেন নি। লিখিত উপাদান ও ঐতিহাসিক তথ্যের অভাবের জন্য' পূর্বে ঐতিহাসিকগণ মনে করতেন আকস্মিক কোন কারণেই হয়ত এই সভ্যতার ধ্বংসপ্রাপ্তি ঘটেছে। তবে বর্তমান আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এমন মতবাদ প্রকাশ করেন যে, এই সভ্যতার ক্রনিক অবক্ষয় হয়েছিল এবং শেষ পর্যায়ে বৈদেশিক আক্রমণ সভ্যতার চরম বিনাশ ডেকে আনে।
আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতবাদের ভিত্তি:
সিন্ধু সভ্যতার ক্রনিক অবক্ষয় মতবাদে বিশ্বাসী আধুনিক ঐতিহাসিকগণ মুখ্যতঃ দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন।
প্রথমতঃ মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পা নগরী ছাড়িয়ে এই সভ্যতা সিন্ধু উপত্যকা সহ গাঙ্গেয় উপত্যকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রসার লাভ করেছিল। সুতরাং এতবড় একটি সভ্যতা আকস্মিক কোন কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে পারে না।
দ্বিতীয়তঃ খননকার্যের ফলে এই সভ্যতার বিভিন্ন স্তরের মধ্যে আধুনিক ঐতিহাসিকগণ ক্রনিক অবক্ষয়ের চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন।
ক্রনিক অবক্ষয়ের কারণ: নিয়মিত বন্যা:
সিন্ধু ও তার উপনদীগুলির নিয়মিত বন্যা এই সভ্যতার অবক্ষয়ের একটি প্রধান কারণ। প্রধান নগরী দুটিতে একাধিকবার ভয়াবহ বন্যার চিহ্ন পাওয়া গিয়ে হ। বাৎসরিক বন্যা ও নদীর গতিপথ পরিবর্তনের সঙ্গে অধিবাসীদের অসম লড়াই এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের বাধ্য করেছিল জীবনের অন্যদিকগুলিকে অবহেলা করতে। যার পরিণাম সামগ্রিক অবক্ষয়।
জলবায়ু:
জীবনের প্রয়োজনে প্রকৃতিকে যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে সিন্ধু সভ্যতার জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। বৃষ্টিবহুল অঞ্চলের জীব যথা- বাঘ, হাতি, মহিষ, গণ্ডার প্রভৃতির ছবি সম্বলিত সীলমোহর আবিষ্কার হওয়ায় মনে করা হয় এই অঞ্চল যথেষ্ট বৃষ্টিবহুল ছিল। কিন্তু ইট নির্মাণ প্রভৃতি কাজে ব্যাপক বনচ্ছেদন এর ফলে জলবায়ুতে ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দেয়। স্যার মার্টিমার হুইলার সিন্ধু সভ্যতার পতনের জন্য এই কারণটিকে অন্যতম মুখ্য কারণ হিসবে চিহ্নিত করেন।
কৃষির অবক্ষয়:
ডি. ডি. কোশাম্বীর মতে কৃষির অবক্ষয় সিন্ধু সভ্যতার চরম ধ্বংসের কারণ। নগর সভ্যতার অস্তিত্ব নির্ভরশীল ছিল কৃষি পণ্যের উৎপাদনের উপর। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তন কৃষি ব্যবস্থার সাথে সাথে সভ্যতারও বিনাশ ডেকে আনে।
ভূমিকম্প:
জলবিজ্ঞান গবেষণার ফলে মহেঞ্জোদাড়োতে প্রাপ্ত কঙ্কালগুলি থেকে অনেকে অনুমান করেন এই সভ্যতা ভূমিকম্পের ফলে ধ্বংস হয়ে যায়। তবে অনেক ঐতিহাসিক এই মতবাদ বিশ্বাস করেন না। মহামারীকেও কেউ কেউ দায়ী করেন।
অন্য প্রাকৃতিক কারণ:
কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন যে জমির উর্বরা শক্তি হ্রাস, লবণতা বৃদ্ধি ও সিন্ধু নদীর পশ্চিম পাড় থেকে বালুচিস্তানের মরুভূমির বিস্তার লাভ এই সভ্যতাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি:
সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের একটি অন্যতম প্রধান কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি। উচ্চস্তরগুলিতে বহুভাগে বিভক্ত গৃহ, বেদখল ও সংকীর্ণ আঁকাবাঁকা রাজপথ, নাগরিক সুযোগ সুবিধার বিলুপ্তি প্রভৃতি জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রমাণ। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কৃষি বিপর্যয়, অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত চাহিদার বৃদ্ধি-চাহিদা যোগানের মধ্যে সৃষ্টি করে সাম্য, নষ্ট হয় স্বাভাবিক ভারসাম্য। এই অবস্থায় কোন সভ্যতার পক্ষেই উজ্জ্বলরূপে টিকে থাকা সম্ভব নয়। সিন্ধু সভ্যতার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
বহিরাক্রমণ:
এই অঞ্চলের প্রাপ্ত কঙ্কালগুলি দেখে ঐতিহাসিকগণ মত প্রকাশ করেন যে বিদেশী শক্তির আক্রমণেই এই সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। হুইলার, কোশাম্বি প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ আর্যদেরকেই এই বিদেশী শক্তি বলে চিহ্নিত করেছেন। বোঘাজ কোই শিলালিপির স্বাক্ষর ও ইরাণিও আর্যদের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তা গাথার নিদর্শন থেকে অনুমান করা হয় প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আর্যগণ ভারতে প্রবেশ করে এবং সিন্ধু ও পাঞ্জাবের প্রাচীন নগরীগুলিকে লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে। হরপ্পায় একটি গণসমাধি, গভীর ক্ষতযুক্ত নরকঙ্কাল প্রভৃতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলি দেখে হুইলার মন্তব্য করেছেন- "The last scene of massacre."
তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারী পরিণাম:
প্রাগৈতিহাসিক যুগের এক উন্নত নাগরিক সভ্যতার বিলুপ্তি হলো সিন্ধু সভ্যতার পতনের তাৎক্ষণিক পরিণাম। তবে এই সভ্যতার জীবনধারা গুজরাটের লোথাল, রাজস্থানের কালিবঙ্গান ও গাঙ্গেয় উপত্যকায় আরো কয়েক শতাব্দী টিকে ছিল। কিছু অধিবাসী বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে গমন করে ও কিছু অংশ আর্য সমাজে দাস ও দস্যুরূপে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে। এদের মাধ্যমেই আর্য ও সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের সংমিশ্রণে এক নতুন সভ্যতার সৃষ্টি হয়, যা হিন্দু সভ্যতা নামে পরিচিত। সিন্ধু সভ্যতার পতনের সুদূরপ্রসারী পরিণাম হিসেবে এই ঘটনাটিকে চিহ্নিত করা যায়।
0 Comments