নবান্ন নাটকের গানের ব্যবহার কতদূর সার্থক হয়েছে যুক্তিসহ আলোচনা করো | 'নবান্ন' নাটকে সংগীতের ব্যবহার কতখানি নাট্য উপযুক্ত হয়েছে আলোচনা করো | নবান্ন নাট

 নবান্ন নাটকের গানের ব্যবহার কতদূর সার্থক হয়েছে যুক্তিসহ আলোচনা করো।

অথবা 


'নবান্ন' নাটকে সংগীতের ব্যবহার কতখানি নাট্য উপযুক্ত হয়েছে আলোচনা করো।




দক্ষিণ দিনাজপুর বালুরঘাট কলেজের একটি প্রজেক্ট 

👇আমাদের ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে সেখানে সরাসরি যুদ্ধ হয়👇




সংগীতের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরকালের। এই সংগীতের প্রয়োগ সার্থকতা বিষয়ে নাট্যক্ষেত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে নির্দেশ করতে দেখা যায়। প্রথমত, সংগীত Dramatic relief সৃষ্টির জন্য ব্যবহৃত হয়। দ্বিতীয়ত, সংগীতের সাহায্যে দর্শকের মনোরঞ্জন ঘটানো হয়। তৃতীয়ত, নাটকের মূল ভাবকে আভাসিত করতে বা ঘটনা ধারার পূর্বাভাস এনে দিতে পারে এবং সর্বোপরি যখন গদ্য সংলাপ কোনো বিষয়কে সার্থকভাবে প্রকাশ করতে অক্ষম হয়, তখন প্রয়োজন হয় সংগীতের। তাই নাটকে সংগীতের গুরুত্ব কম নয়।



কিন্তু 'নবান্ন' প্রথাসিদ্ধ নাটক নয়। এবং বলা চলে 'এপিকধর্মী' এই নাটক অনেকটাই 'এপিসোডিক' প্যাটার্নের। একের পর এক দৃশ্যের উপস্থাপনায় একটা যুগের, একটা কালের, একটা সংকটের মুহূর্তকে আভাসিত করে। তারই মাঝে বারে বারে এসেছে দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, সামাজিক অবক্ষয়, মানুষের সর্বনাশা পরিণতির কথা।

 এককথায় চল্লিশের দশকের ভাঙাগড়ার প্রতিচ্ছবি বারে বারে ফিরে এসেছে। আর তাই সেই সর্বনাশা অবস্থার ভয়াবহ সাক্ষী হয়ে উঠেছে আমিনপুরের কৃষক পরিবার। মারি-মড়ক-মন্বন্তরের করাল ছায়ায় কঙ্কালসার ভিখারিতে পরিণত তারা। মানুষের এই দুর্দৈব এবং বিপর্যয়ের ধাক্কাটা এতই প্রবল যে সেখানে জীবন যেন দিশেহারা। ঘটনা প্রাবল্যের দুরন্ত গতি এবং দুর্যোগের অনতিক্রম্য ঘনঘটায় জীবন এসে দাঁড়িয়েছে মৃত্যুর মুখোমুখি। কাজেই এ জীবনে গানের ভূমিকা কোথায়?-শুষ্ক মরুবালিতে প্রাণের আর্তি?-তৃয়ার জল?
কিন্তু রাতের অন্ধকারের মধ্যেই থাকে 'ফুটন্ত সকালে'র প্রতিশ্রুতি। তাই 'নবান্ন' নাটকে প্রথম অঙ্কে দুর্যোগের পটভূমি, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অঙ্কে বিপর্যস্ত মানুষের বাঁচার তাগিদে ফুটপাতে মাথা কুটে মরার ছবি পরিবেশিত। এখানে বারে বারে শোনা যায়, মৃতের প্রতি 'হরিবোল' ধ্বনি কিংবা জীবিতের বাঁচার আকাঙ্ক্ষায় মাগো, মাগো ধ্বনি। এগুলি হয়তো কোনো সুর-তালে প্রকাশিত নয়। কিন্তু কারুণ্যের এই আর্তধ্বনি তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ করুণ সংগীতের মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। কারণ-"Our sweetest songs are those that tell of saddest thought." জীবনশিল্পী নাট্যকার স্বাভাবিক নিয়মেই প্রচলিত সংগীতের আশ্রয় নিতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু এই হাহাকার ধ্বনিই হয়ে উঠেছে সংগীত; সৃষ্টি করেছে সুগভীর সাংগীতিক মূর্ছনা।


চতুর্থ অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে শোনা যায় নিরঞ্জনের কণ্ঠে সংগীত। দ্বিতীয় দৃশ্যে শোনা যায় গ্রামের ফকিরের কণ্ঠে সংগীত এবং তৃতীয় দৃশ্যে শোনা যায় গ্রামের কৃষক রমণীদের কণ্ঠে সংগীত। তবে গানগুলি শুধুই আনন্দের ফোয়ারা সৃষ্টি করে না, বরং বলা চলে কোথায় যেন একটা বেদনাবোধ, কোথায় যেন একটা ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি রোমন্থন, ফেলে আসা দুঃখের দহন জ্বালা। আবার একই সঙ্গে সেখানে পরিবেশিত হয়েছে অনাগত জীবনের প্রস্তুতি, আগত ভবিষ্যতের সুখ সম্ভাবনা এবং দুঃখ বিতাড়নের প্রয়াস। সব মিলিয়ে এ গানগুলি 'নবান্ন' নাটকের জীবনসংগ্রামে অংশীভূত হয়ে গেছে। এ গানগুলি যেন হয়ে উঠেছে নাটকের প্রাণভ্রমরা। চতুর্থ অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে নিরঞ্জনের কন্ঠে শোনা যায়-
 
"বড় জ্বালা বিষম জ্বালায় পুড়ে পুড়ে হব সোনা, সে কথা তো মিথ্যা হল 
হলাম অনুপায়।"


এই গানটি। নিরঞ্জন বুঝেছে, দুঃখের দহনের মধ্যে দিয়েই সুখের আগমন ঘটে। জীবনের চলতি পথের পাথেয় নিয়ে নিরঞ্জন বুকের বিষম জ্বালা সত্ত্বেও বুঝেছে এবার বুঝি সুখের দিন এসেছে। এই কথাগুলিই তার গানে পরিবেশিত। চতুর্থ অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে শোনা যায় ফকিরের কণ্ঠে গান। এই গানটি বেশ • দীর্ঘ এবং পাঁচালির ঢঙে পরিবেশিত। গানটির বিষয়বস্তুতে আছে ফেলে আসা দুঃস্বপ্নের ছবি এবং টুয়োপদের মতো একটি কথা বার বার ফিরে এসেছে-


"আপনি বাঁচলে তো বাপের নাম মিথ্যা সে বয়ান। হিন্দু মুসলমান যতেক চাষী দোস্তালি পাতান।।"


অর্থাৎ সংগীতের মধ্যে আছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুর। সেই সঙ্গে এই সংগীতটিতে পরিবেশিত হয়েছে দুঃখের রাতের শেষে নবীন সূর্যোদয়ের আভাস। পাশাপাশি দেখানো হয়েছে, মাঠে মাঠে ফসল পেকেছে কিন্তু সেই ফসল কাটার সমস্ত লোক আজ আর নেই। অনেকেই হারিয়ে গেছে দুর্ভিক্ষের মহামারিতে। তাই পাকা ধানের সুঘ্রাণের আনন্দের সঙ্গে বেদনার স্মৃতিও রয়ে গেছে। কিন্তু এখন তো আর ভেঙে পড়বার সময় নয়। তাই আঘাতজর্জর মানুষকে আবার নিজের শক্তি নিয়ে জেগে ওঠার কথা বার বার উচ্চারিত হয়েছে ফকিরের কণ্ঠে ধ্বনিত সংগীতে। এককথায় 'নবান্ন' নাটকের মূল বিষয় ও ভাববস্তু এই সংগীতে পরিবেশিত।


চতুর্থ অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যে সংগীত শোনা যায় কৃষক রমণীদের কণ্ঠে। একদিন তারা দুর্ভিক্ষ মহামারিতে পথের ভিক্ষুকে পরিণত হয়েছিল। আজ তাদের সুদিন ফিরেছে। মাঠ ফসলে পূর্ণ হয়েছে। গ্রামের কৃষকরা আজ মেতে উঠেছে 'নবান্ন' উৎসবে। শত বিপর্যয়ের পরও তারা যেন জীবনে বেঁচে উঠার মন্ত্র খুঁজে পেয়েছে। মরা গাঙের ধারে, বিগত আকালের সুস্পষ্ট কঙ্কালের ছাপ এখনো মানুষের শরীরে। সেই মরা গাঙের ধারে অস্তমিত সূর্যের রক্তিমাভায় অফুরন্ত প্রাণস্ফূর্তিতে যেন মেতে উঠেছে গ্রামের কৃষাণ-কৃষাণীর দল। তাই তাদের কণ্ঠে শোনা যায়-


"নিস্লো চেয়ে সামনের হাটে গলার হাঁসুলি ডুরে শাড়ি পাছাপাড়, আর হার সাতনলি। কনে দেখা আলো মেখে আসবে বঁধু আলবেয়ে

দেখে হেসে সরে যাবি কথা না কয়ে।।"


গানটিতে যেন স্বচ্ছলতার আভাস, সুখের পরিবেশের ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যায়। দিনযাপনের গ্লানি আর প্রাণধারণের পীড়া একদিন যাদের কণ্ঠ থেকে গান কেড়ে নিয়েছিল, আজ যেন আনন্দের দিনে, তাদের নতুন জীবনে তাদের কণ্ঠে আবার গান ফিরিয়ে দিয়েছে, যেন নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে।

তাই সবদিক বিচার করে বলা চলে, 'নবান্ন' নাটকের প্রথম তিনটি অঙ্কে রুদ্ধশ্বাস পরিবেশে, মন্বন্তরের ভয়াল প্রেতচ্ছায়ায় সংগীত ব্যবহারের যে সুযোগ ছিল না, নাট্যকার চতুর্থ অঙ্কের মুক্ত পরিবেশে সে সুযোগ পেয়ে তিনটি দৃশ্যে মাত্র তিনটি সংগীত প্রয়োগ করেই নাট্যোমোদী দর্শকের মনোরঞ্জন করেছেন। বিশেষ করে ফকিরের কণ্ঠে দীর্ঘ বিবৃতিমূলক সংগীত পরিবেশন করে যেমন নাটকের অন্তিম লগ্নকে করেছেন দীর্ঘায়িত, ঠিক তেমনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাণীপাঠ করেছেন। ফলে নাটকের সংলাপে যা সম্পূর্ণ করা সম্ভব হয়নি তা মাত্র তিনটি সংগীত পরিবেশনেই নাট্যকার সফলকাম হয়েছেন এবং নবান্নের মিলন উৎসবকে করে তুলেছেন রসঘন। 
ফলে 'নবান্ন'নাটকে সংগীতের ব্যবহার বিশেষ সার্থকতা লাভ করেছে বলা যায়।


Post a Comment

0 Comments