হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর লেখা 'বেনের মেয়ে' উপন্যাসের তৎকালীন সমাজের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা আলোচনা করো
Or
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর "বেনের মেয়ে" উপন্যাসের বিষয়বস্তু আলোচনা করো।
বঙ্গদর্শন-এ কাঞ্চনমালা প্রকাশের ছত্রিশ বছর পর 'বেনের মেয়ে' উপন্যাস প্রকাশিত হয়। 'বেনের মেয়ে' উপন্যাসের পটভূমি হাজার বছর আগের প্রাচীন বাংলার একটি বিশেষ অঞ্চলের বৌদ্ধ ও হিন্দু অধ্যুষিত জনজীবনের সামাজিক ইতিবৃত্ত। বৌদ্ধধর্মের প্রভাবের অবসান এবং হিন্দু ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরুত্থান এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। মূল এই বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে হরপ্রসাদ ওই নির্দিষ্ট অঞ্চলের জনজীবনের চাষআবাদ-কারুশিল্প-ব্যবসাবাণিজ্য-শিল্পকলাচর্চা-স্থাপত্য কলা-বিদ্যাচর্চা-সব মিলিয়ে দুটি ধর্মের সমাজ বিন্যাসের এক ব্যাপক প্রেক্ষাপট তুলে আনেন তাঁর আখ্যানে। বণিক বিহারী দত্তের মেয়ে মায়াকে নিয়ে উপন্যাসের আখ্যাপত্র হলেও এই কাহিনী সে অর্থে কোনও নায়ক-নায়িকার গল্প নয়। সাতগাঁ, প্রাচীন বন্দর সপ্তগ্রামের শহর ও গ্রাম-গ্রামান্তর নিয়ে এক বৃহৎ ভূখণ্ডের জনজীবনের ইতিহাস এই গল্পের প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেছে। হরপ্রসাদ দেশের ইতিহাস বলতে বুঝতেন জনসমাজের ইতিহাস। সাতগাঁর বৌদ্ধ রাজা রূপা বাগ্দীর রাজত্বলোপ এবং হিন্দু ব্রাহ্মণ হরিবর্মার রাজা হওয়ার ঘটনার মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরের ইঙ্গিত থাকলেও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বদল এ উপন্যাসে গৌণ ব্যাপার। রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলের মূলে যে প্রবল সামাজিক শক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কাজ করে-সেই দ্বন্দু-সংঘাতময় সমাজ জীবনের পূর্ণাঙ্গ রূপটি তুলে ধরাই ঔপন্যাসিকের মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে। সামাজিক ইতিহাসের একজন প্রগাঢ় গবেষক হিসেবে হরপ্রসাদ বুঝেছিলেন যে, কোনো রাজরাজড়ার কাহিনী, যুদ্ধ, জয় পরাজয়ের কাহিনীতে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনের সামগ্রিক রূপ ধরা পড়ে না। দেশের অর্থনৈতিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সম্পর্ক কেমন করে ভাঙে-গড়ে, জাতপাতের টানাপোড়েনে, খাদ্যাভ্যাসের বুচি, বিভিন্ন বৃত্তিধারী মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক-জনজীবনের এই সমস্ত দিকের বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ 'বেনের মেয়ে'-র বড়ো সম্পদ।
'বেনের মেয়ে' ঐতিহাসিক উপন্যাস নয় বলে মন্তব্য করেছেন স্বয়ং ঔপন্যাসিক। তিনি বইটির 'মুখপাত'-এ বলেছেন, "বেনের মেয়ে” ইতিহাস নয়; সুতরাং ঐতিহাসিক উপন্যাসও নয়। ইতিহাস না হলেও এই গল্পে প্রচুর ঐতিহাসিক ব্যক্তির সমাবেশ ঘটেছে। যেমন, লুই সিদ্ধা, যিনি চর্যাপদের (হরপ্রসাদের বিখ্যাত আবিষ্কার) প্রথম পদকর্তা লুইপাদ, হরিবর্মদেব, তাঁর প্রধান উপদেষ্টা ভবদেব ভট্ট, প্রশস্তপাদ, পাণ্ডুদাস, বাচস্পতি মিশ্র, যোগ্লোক, মহীপাল, রাজা ইন্দ্রভূতি, বজ্রদত্ত, শান্তিদেব, রত্নাকর শান্তি, শ্রীহর্ষ, শ্রীহীর প্রভৃতি। এইসব ঐতিহাসিক চরিত্ররা সবাই সমসাময়িক সময়ের ব্যক্তি ছিলেন না। দীর্ঘকালে ব্যাপ্ত বাঙালি জীবনের
বেনের মেয়ে'-র মাত্র দুই দশকের সীমার মধ্যে ধরতে গিয়ে অনিবার্যভাবে উপন্যাসে কালাতিক্রমণ দোষ ঘটেছে তবে এই ঐতিহাসিক বিচ্যুতিতে 'বেনের মেয়ে'-র সাহিত্য কমে যায় না।
উপন্যাস শুরু হয়েছে ৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে, বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে গাজনের উৎসব ও সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের রূপা রাজার ধরমপুর সঙ্ঘারামে বিহার প্রতিষ্ঠার মধ্যে, শেষ হয়েছে হিন্দু রাজা হরিবর্মার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা এবং হরিবর্মার রাজসভায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কলাকার-শিল্পীদের প্রতিযোগিতা ও পুরস্কারপ্রাপ্তির মধ্যে দিয়ে এবং বৌদ্ধ গুরুপুত্রের রাজসভায় ধিকৃত হয়ে সাতগাঁ ছেড়ে যাবার উদ্যোগে। সাতগাঁয়ে বৌদ্ধধর্মের হ্রাস এবং হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান-এই ফ্রেমের মধ্যে হরপ্রসাদ যেভাবে গল্পের বিস্তার করেছেন তার পরিধি বিরাট। মূল গল্পের সঙ্গে আছে বেনে বিহারী দত্তের গল্প, মায়ার গল্প, গুরুপুত্র ও মস্করীর গল্প। মশলার বেনে বিহারী দত্তের অগাধ টাকা, কিন্তু তার মনে সুখ নেই। একমাত্র সন্তান মায়া বিয়ের চার বছর পরে বিধবা হয়। মায়ার স্বামী জীবন ধনী, যক্ষ্মারোগে মারা যায়। নিঃসন্তান মায়া বাবা ও শ্বশুরের বিপুল সম্পত্তি কী করে রক্ষা করবে ভেবে পায়না। বৌদ্ধ রাজা রূপা বাগ্দী ও বৌদ্ধবিহারের দলবল ষড়যন্ত্র করে মায়াকে অপহরণ করে বিহারে নিয়ে গিয়ে গুরুপুত্রের সাধনার যোগিনী করে দিলে মায়ার বিরাট সম্পত্তি বিহারের অধিগত হবে। এই ষড়যন্ত্রে জল ঢেলে দেয় মস্করী, যার আসল নাম পিশাচখণ্ডী; যিনি হিন্দুশাস্ত্র প্রগাঢ় পণ্ডিত এবং চৌষট্টিকলায় দারুণ পটু। তিনি বৌদ্ধভিক্ষুণীর বেশে মায়াকে তার স্বামীর চিত্রদর্শন করবার কথা বলে গোপনে সরিয়ে নিয়ে যান। বৌদ্ধরা মায়াকে অপহরণ করেছে-এই সন্দেহে হিন্দু-বৌদ্ধের যুদ্ধ বেঁধে যায়। এই যুদ্ধে বৌদ্ধধর্মের প্রতিপত্তি নিঃশেষ হয় এবং হিন্দু রাজত্বের সূচনা হয়। যদিও হিন্দুরা ধরমপুরের বৌদ্ধবিহার ধ্বংস করেনি কিন্তু ভারী রাজসভায় মায়ার উদ্দেশ্যে কামনা উদ্রেককারী কবিতা পাঠ করে গুরুপুত্র তিরস্কৃত হন এবং তিনি বৌদ্ধবিহার ছেড়ে যাবার জন্য তৈরি হন। এই আখ্যানে উপন্যাস শেষ হয়। হিন্দু-বৌদ্ধের ঝগড়া-অশান্তি এবং মায়াকে কেন্দ্র করে যুদ্ধের বাতাবরণ তৈরি হলেও 'বেনের মেয়ে' উপন্যাসে এই দুই ধর্মসম্প্রদায়ের সহাবস্থান, উভয় ধর্মের প্রতি পরস্পরের বিশ্বাস-ভক্তির কথাও বলা হয়েছে। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নৈতিক অধঃপতন, চারিত্রিক স্খলন এবং লোভ ও কদাচারেই যে সাতগাঁয়ের বৌদ্ধ প্রভাব ধ্বংস হয়ে যায়-এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন গল্পকার।
0 Comments