প্রাণায়ামের প্রকারভেদ আলোচনা করো।
প্রাণায়ামের প্রকারভেদ
প্রাণায়াম (Pranayama) শব্দটি দুটি সংস্কৃত শব্দের সমন্বয়ে গঠিত – "প্রাণ" (Prana) অর্থাৎ প্রাণশক্তি এবং "আয়াম" (Ayama) অর্থাৎ প্রসারণ বা নিয়ন্ত্রণ। প্রাণায়াম হল এক প্রকার শ্বাসনিয়ন্ত্রণের বিজ্ঞান, যা শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য যুগ যুগ ধরে যোগশাস্ত্রে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
প্রাণায়ামের অনেক প্রকারভেদ আছে। প্রতিটি প্রাণায়ামই আলাদা উদ্দেশ্যে ও ফলাফলের জন্য ব্যবহৃত হয়। নিচে কিছু প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকারভেদ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:
১. নাদি শুদ্ধি বা নাড়ী শোধন প্রাণায়াম (Nadi Shuddhi / Nadi Shodhana Pranayama)
অর্থ: নাড়ী (শরীরের প্রাণশক্তির চ্যানেল) শুদ্ধি।
পদ্ধতি:
- ডান নাসিকা বন্ধ রেখে বাম দিক দিয়ে শ্বাস গ্রহণ।
- তারপর বাম নাসিকা বন্ধ করে ডান দিক দিয়ে শ্বাস ত্যাগ।
- পুনরায় ডান দিক দিয়ে শ্বাস গ্রহণ করে বাম দিয়ে ত্যাগ।
উপকারিতা: - মন শান্ত করে
- মানসিক চাপ কমায়
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে
- স্নায়ু শান্ত করে
২. ভস্ত্রিকা প্রাণায়াম (Bhastrika Pranayama)
অর্থ: ভেল্লুন বা ধাতব বেলো (Bellows)-এর মতো জোরে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া ও ছাড়া।
পদ্ধতি:
- নাক দিয়ে দ্রুত ও গভীরভাবে শ্বাস নেওয়া এবং দ্রুত ছাড়া।
- সাধারণত ১০–২০ বার করে এক সেট করা হয়।
উপকারিতা: - ফুসফুসের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
- শরীরকে উত্তেজিত ও সক্রিয় করে
- টক্সিন দূর করে
- ঠান্ডা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদিতে উপকারী
৩. কপালভাতি প্রাণায়াম (Kapalabhati Pranayama)
অর্থ: "কপাল" মানে কপাল এবং "ভাতি" মানে দীপ্তি বা জ্যোতি।
পদ্ধতি:
- নাক দিয়ে দ্রুত শ্বাস ত্যাগ এবং ধীরে ধীরে শ্বাস গ্রহণ।
- ত্যাগের সময় পেট ভেতরে টেনে নেওয়া হয়।
উপকারিতা: - পেটের চর্বি কমাতে সাহায্য করে
- হজমশক্তি বাড়ায়
- মুখমণ্ডলে উজ্জ্বলতা আনে
- যকৃত ও কিডনি কার্যক্ষম রাখে
৪. অনুলোম-বিলোম (Anulom Vilom)
অর্থ: এক নাসিকা দিয়ে শ্বাস গ্রহণ ও বিপরীত নাসিকা দিয়ে শ্বাস ত্যাগ।
পদ্ধতি:
- ডান নাসিকা বন্ধ রেখে বাম দিয়ে শ্বাস গ্রহণ, ডান দিয়ে ত্যাগ
- আবার ডান দিয়ে গ্রহণ, বাম দিয়ে ত্যাগ
উপকারিতা: - মস্তিষ্কের ভারসাম্য বজায় রাখে
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
- মানসিক চাপ কমায়
৫. শীতলী ও শীতকারি প্রাণায়াম (Sheetali & Sheetkari Pranayama)
অর্থ: ঠান্ডা বা শীতল করার প্রক্রিয়া
পদ্ধতি:
- শীতলী: জিভ বাঁকিয়ে পাইপের মতো করে মুখ দিয়ে শ্বাস গ্রহণ, নাক দিয়ে ত্যাগ
- শীতকারি: দাঁতের ফাঁক দিয়ে শ্বাস গ্রহণ, নাক দিয়ে ত্যাগ
উপকারিতা: - দেহ ও মন ঠান্ডা করে
- গ্রীষ্মকালে উপকারী
- হজমের সমস্যা কমায়
৬. ব্রামরী প্রাণায়াম (Bhramari Pranayama)
অর্থ: "ব্রামর" মানে মৌমাছি। শ্বাস ছাড়ার সময় মৌমাছির গুঞ্জনের মতো শব্দ করা হয়।
পদ্ধতি:
- চোখ বন্ধ করে, কানে আঙুল দিয়ে হালকা চাপে ধরা
- নাক দিয়ে গভীর শ্বাস গ্রহণ করে মুখ বন্ধ রেখে গুঞ্জনের মতো শব্দ করে ছাড়া
উপকারিতা: - মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা দূর করে
- ঘুম ভালো হয়
- স্মৃতিশক্তি বাড়ায়
- কানের সমস্যা কমায়
৭. উজ্জায়ী প্রাণায়াম (Ujjayi Pranayama)
অর্থ: বিজয়ী শ্বাস
পদ্ধতি:
- গলার পেছনের অংশ সঙ্কুচিত করে নাক দিয়ে ধীরে শ্বাস নেওয়া ও ছাড়া
- হালকা ঘড়ঘড়ে শব্দ হয়
উপকারিতা: - থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে রাখে
- মনোসংযোগ বাড়ায়
- শরীরকে উত্তপ্ত করে
৮. সূর্যভেদী ও চন্দ্রভেদী প্রাণায়াম (Surya Bhedana & Chandra Bhedana)
সূর্যভেদী:
- ডান নাসিকা দিয়ে শ্বাস গ্রহণ, বাম দিয়ে ছাড়া
- শরীরকে উত্তপ্ত করে
চন্দ্রভেদী: - বাম নাসিকা দিয়ে শ্বাস গ্রহণ, ডান দিয়ে ছাড়া
- শরীরকে ঠান্ডা করে
উপসংহারঃ
প্রাণায়ামের প্রত্যেকটি ধরন আমাদের শরীর ও মনের ওপর বিভিন্ন প্রভাবে কাজ করে। নিয়মিত ও সঠিকভাবে প্রাণায়াম অনুশীলন করলে শারীরিক স্বাস্থ্য, মানসিক প্রশান্তি, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সম্ভব হয়।
তবে, কোনো গুরুতর শারীরিক সমস্যা থাকলে যোগব্যায়াম বিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রাণায়াম শুরু করা উচিত।
উজ্জ্বল দেবনাথ সবার কথা মাথায় রেখে তিনি এই সুন্দর উত্তরটি দিয়েছেন।
0 Comments