"কিন্তু মানুষের বুদ্ধির দৌড় তার বোধের চেয়ে অনেক বেশি, জগতের সকল দৌড়ের সঙ্গে সে পাল্লা দেবার স্পর্ধা রাখে।”- আলোচ্য মন্তব্যের মধ্যদিয়ে প্রাবন্ধিক কি বলতে চেয়েছেন তা 'পরমাণু' অংশ অবলম্বনে আলোচনা করো।
"কিন্তু মানুষের বুদ্ধির দৌড় তার বোধের চেয়ে অনেক বেশি, জগতের সকল দৌড়ের সঙ্গে সে পাল্লা দেবার স্পর্ধা রাখে।”- আলোচ্য মন্তব্যের মধ্যদিয়ে প্রাবন্ধিক কি বলতে চেয়েছেন তা 'পরমাণু' অংশ অবলম্বনে আলোচনা করো।
উত্তর:- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তা ভাবনা ছিল সুদূরপ্রসারী। আর তাই তো তার বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে তাঁর প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। ঠিক এইরকমই বৃহত্ততর চিন্তাভাবনার ফসল হলো 'বিশ্বপরিচয়' প্রবন্ধ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে পরমাণু অংশে জানিয়েছেন- আমাদের মানব শরীরে রয়েছে পঞ্চইন্দ্রিয় যা আমাদের বিভিন্ন শক্তি প্রদান করে। যেমন শোনার বোধ, ঘ্রাণের বোধ, স্বাদের বোধ, স্পর্শের বোধ। তবে এইসব শক্তির রয়েছে সীমাবদ্ধতা। অর্থাৎ লেখক বলতে চেয়েছেন যে, আমাদের দৃষ্টি একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। তার ঊর্ধ্বে যাওয়া সম্ভব নয়। আবার নির্দিষ্ট দূরত্বের আওয়াজই আমাদের কানে পৌছায়। রবীন্দ্রনাথের মতে আমাদের এই সকল বোধশক্তি যে বিকশিত হয়েছে তা কেবলই এই পৃথিবীর অনুপাতে তা বিশ্বব্রম্ভান্ডের নিরিখে গড়ে উঠেনি। প্রাচীন যুগে মানুষ ভাবত তাঁর দৃষ্টি যতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ঠিক ততদূর পর্যন্তই পৃথিবীর সীমানা। অর্থাৎ তার বাহিরে আর জগৎ নেই। কিন্তু মানুষ যখন নৌবহর নিয়ে সমুদ্রপথে বের হলো তখন তার দৃষ্টি একে একে খুলতে লাগল। সে জানতে পারল তার দৃষ্টির বাইরেও রয়েছে জগৎ। ঠিক তেমনি সূর্যের আলোয় আমরা যতটুকু দেখতে পাই তার উর্ধ্বে আমাদের দৃষ্টি আর এগোতে পারে না বিশ্বব্রম্ভান্ডে। কেননা সূর্যের আলো তাতে বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু রাতেও অন্ধকার আমাদের সঙ্গে পরিচয় ঘটায় আকাশের সেই অজানা নক্ষত্রমন্ডলীর সঙ্গে। তখন আমরা বুঝতে পারি “জগতের সীমানা পৃথিবী ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে গেছে।” সেই বোধটা শুধুমাত্র আমাদের ঘটে থাকে আমার চোখের দৃষ্টির ওপর নির্ভর করে। কেননা শব্দের মাধ্যমে সেই বোধ নেওয়া সম্ভব নয়। শব্দের বোধ কেবল হাওয়ায় থাকে। বিজ্ঞান সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের ধ্যানধারণা যে অনেকটাই উন্নতমানের ছিল তারই পরিচয় পাওয়া যায় কবির এই মন্তব্যে। কারণ প্রাবন্ধিক খুব ভালোভাবে জানতেন যে হাওয়া বিহীন স্থান থেকে কোনোভাবেই শব্দ আসতে পারে না। আর যেহেতু এই হাওয়া কেবল আমাদের পৃথিবীতেই সীমাবদ্ধ তাই আমরা পৃথিবীতে সৃষ্ট হওয়া বিভিন্ন শব্দ শুনতে পারি। বিশ্বব্রম্ভান্ডের নয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন পৃথিবীর বাইরে ঘ্রাণ আর স্বাদের কোনো অর্থেই অস্তিত্ব নেই। তবে শুধু ভালোভাবে অনুভব করা যায় সূর্য থেকে পাওয়া রোদের তাপ। সেই আলোই আমাদের পৃথিবীর প্রাণের উৎস। সূর্য ছাড়াও এই ব্রম্ভান্ডে অনেক নক্ষত্র রয়েছে। তবে সেগুলির তাপ আমরা পাই না। পাই শুধু সূর্যের তাপ। তাই লেখক সূর্যকে আত্মীয় বলে সম্বোধন করেছেন। তবে প্রাবন্ধিক এও স্পষ্ট করেছেন যে, সূর্য আমাদের থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে। প্রায় নয় কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল দূরে। তাই রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন - শুনে চমকে উঠলে চলবেনা। যে ব্রম্ভান্ডে আমরা আছি এখানে ঐ দূরত্বটা নক্ষত্রলোকের সকলের চেয়ে নীচের ক্লাসের। কোনো নক্ষত্রই ওর চেয়ে পৃথিবীর কাছে নেই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন বিশ্বব্রম্ভান্ডের এইসব অজানা রহস্য জানলে আমাদের স্বাভাবিক ভাবেই আশ্চর্য লাগে। কারণ আমাদের বাসভূমি পৃথিবী আকৃতিতে অনেকটাই ছোটো। সেই জায়গায় বিশ্বব্রম্ভান্ডের অজানা তত্ত্ব আমরা যত জানব সেই জায়গায় এই পরিমাণটা অনেকটা ক্ষুদ্র বলে মনে হবে। যেহেতু আমাদের বোধশক্তির সীমা একটি নির্দিষ্ট গন্ডিতে আবদ্ধ তাই এর বাইরে জগৎকে আমরা সহজেই কল্পনা করতে পারি না। কিন্তু আমাদের অনুভূতি শক্তির বাহিরেও একটি শক্তি আছে যা দিয়ে আমরা এই দূরত্ব গবেষণার ইচ্ছাকে আরও অগ্রগামী আমরা এমন এক বিশ্বব্রম্ভান্ডে বাস করি যেখানে প্রত্যেক বস্তুই নিজের দিকে টানে। বস্তুমাত্র যে আকাশে থাকে তার একটা বাঁকানো গুণ আছে। মহাকর্ষে তারই প্রকাশ। এই বিষয়টি সর্বব্যাপী এটা পরিবর্তন করা যায় না। এমনকি আলোকশক্তি ও এই নিয়ম মেনে চলতে হয়। মহাকর্ষ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন “যাই হোক, ইংরেজিতে যাকে গ্রাভিটেশন বলে তাকে মহাকর্ষ না বলে ভারাবর্তন নাম দিলে গোল চুকে যায়।” পরিশেষে বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আলোচ্য অংশে মহাকর্ষজ টানের বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দর ভাবে উপস্থাপিত করেছেন। শুধু তাই নয়, সাহিত্যের সঙ্গে বিজ্ঞানকে একত্রে মিলিত করে এমন ভাবে উপস্থাপনা করেছেন যাতে আমাদের মহাকাশ সম্বন্ধে ধারণাকে জানবার আগ্রহকে দ্বিগুণ করে তুলেছে।
0 Comments