রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরচিত 'বিশ্বপরিচয়' এর 'নক্ষত্রলোক অংশ অবলম্বনে মহাকর্ষজ টান ও তা নিয়ে যেসব বিজ্ঞানীর মতামত রয়েছে তা বর্ণনা করো।

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরচিত 'বিশ্বপরিচয়' এর 'নক্ষত্রলোক অংশ অবলম্বনে মহাকর্ষজ টান ও তা নিয়ে যেসব বিজ্ঞানীর মতামত রয়েছে তা বর্ণনা করো।


✅উত্তর:-

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ হলো "বিশ্বপরিচয়"। উক্ত প্রবন্ধটি ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হলো। জ্যোতিবিজ্ঞান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কৌতূহল এই গ্রন্থে বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ নিউট্রন ও ইলেকট্রন আবিষ্কারের পাশাপাশি নক্ষত্রলোক' অংশে মহাকর্ষজ টান ও বিভিন্ন বিজ্ঞানীর মতামত তুলে ধরেছেন।
বিশ্বব্রম্ভান্ডের সমস্ত বস্তুই একটি নির্দিষ্ট মহাকর্ষজ টানে নিজেদেরকে ধরে রেখেছে। অনেকটা যেমন ইলেকট্রন-প্রোটন-নিউট্রন নিজেদেরকে বেঁধে রেখেছে ঠিক তেমনি। যদিও রবীন্দ্রনাথ এই কথা বলতে গিয়ে বলেছেন যে, মহাকর্ষের টান হলো একটু ভিন্ন, এটা হলো বৈদ্যুতিক টান। অর্থাৎ পরমাণুর ভেতরের টানটা হলো বিদ্যুতের টান বাইরে টানটা মহাকর্ষের, অনেকটা ঠিক মানুষের ঘরের টানটা যেমন আত্মীয়তার কিন্তু বাইরের টানটা সমাজের। মহাকাশে সূর্যকে কেন্দ্র করে সর্বদা গ্রহগুলি ঘুরছে। এই ঘূর্ণিপাকের গতিবেগ এক সেকেন্ডে প্রায় দুশো মাইল। অনেকটা চলতি ঢাকা থেকে কাদা ছিটকে পড়বার মতো, কিন্তু তা সত্ত্বেও সূর্য থেকে গ্রহগুলি ছিটকে বাইরে বের হয়ে যাচ্ছে না, তা রয়েছে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যেই।
বিজ্ঞানশ্রেষ্ঠ নিউটন একদিন লক্ষ্য করলেন যে গাছ থেকে আপেল মাটিতে পড়ে কিন্তু তা উপরে যায় না। এই কথা মাথায় আসতেই তাঁর মাথায় এই প্রশ্নটিও দানা বাঁধে যে তাহলে চাঁদ কিসের টানে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে? পৃথিবী কিসের টানে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে? আপেল মাটিতে পড়বার ব্যাপারে তিনি এটি খুব সহজেই বুঝেছিলেন যে কিছু একটা টানের শক্তি রয়েছে পৃথিবীতে যার দরুণই এটি ঘটছে। তিনি এটি ও বোঝেন যে এই শক্তি রয়েছে সর্বত্র। নিউটনের এই ভাবনাটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে লাগল। তিনি বুঝতে পারলেন যে, শুধু পৃথিবী নয় সব কিছুই সব কিছুকে টানে।
এই মহাকর্ষের টান বোঝাতে গিয়ে প্রাবন্ধিক আর একটি বিজ্ঞানীর কথা বলেছেন তিনি হলেন লর্ড ক্যাভেন্ডিশ। তিনি দুটি সীসের গোলা ঝুলিয়ে | দেখিয়েছেন যে দুটি বস্তু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই নিজেদেরকে টানছে। অর্থাৎ এই পৃথিবীর সকল জিনিসই একে অপরকে টানছে।” যে পিঁপড়েটা এসেছে আমার ঘরের কোণে আহারের খোঁজে তাকেও টানছি- সেও দূর থেকে দিচ্ছে আমায় টান” পৃথিবীর এই টানের ব্যাপারটিকে রবীন্দ্রনাথ রসিকতা করে বলেছেন- “পৃথিবী এই আঁকড়ে ধরার জোরে অসুবিধা ঘটিয়েছে অনেক। চলতে গেলে পা
তোলার দরকার। কিন্তু পৃথিবী টানে তাকে নীচের দিকে দূরে, যেতে হাঁপিয়ে পড়ি, সময়ও লাগে বিস্তর।” তবে প্রবন্ধটি যে কবির শেষ বয়সে লেখা তারও বার্তা বহন করে এই কথাটি। যদিও এই টেনে রাখার ব্যাপারটা গাছপালাদের জন্য যথেষ্ট সুখকর সেটিও বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। এই টেনে রাখবার কারণে আমরা যে পৃথিবীতে আটকে আছি। এই ব্যাপারে প্রাবন্ধিক একটু মনক্ষুণ্ণ হয়েছেন। কেননা এই অভিকর্ষজ টান যদি না থাকত তবে আমরা মানুষেরা আকাশে উড়ে বেড়াতে পারতাম। কবির এই চাওয়া অনেকটাই তাঁর শিশুসুলভ মনের প্রকাশ। কিন্তু পৃথিবী তার অভিকর্ষজ টানে আমাদেরকে বেঁধে রেখেছে মাটিতে। মানুষ যদিও পৃথিবীর এই টানকে টেক্কা দিয়েছে। বানিয়েছে আকাশযান। কিন্তু তারপর যখন প্রাবন্ধিক জানতে পারেন যে, অভিকর্ষজ টান না থাকলে আমরা পৃথিবী থেকে কে কোথায় ছিটকে পড়ব কোন ঠিকানা থাকবে না, তখন তিনি এই টানকে মনে মনে নমস্কার করেছেন। বলেছেন-“পৃথিবীর টানটা এমন ঠিক
মলিত পূথিবার এই টানকে টেক্কা দিয়েছে। বানিয়েছে আকাশযান। কিন্তু তারপর যখন প্রাবন্ধিক জানতে পারেন যে, অভিকর্ষজ টান না থাকলে আমরা পৃথিবী থেকে কে কোথায় ছিটকে পড়ব কোন ঠিকানা থাকবে না, তখন তিনি এই টানকে মনে মনে নমস্কার করেছেন। বলেছেন-“পৃথিবীর টানটা এমন ঠিক মাপে হয়েছে যাতে আমরা চলতে পারি অথচ পৃথিবী ছাড়তে পারি না।”
বহুদিন বিশেষত নিউটনের সময় থেকেই এই মহাকর্ষের ব্যাপারটি চলে। আসছে। তার সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করেই আমরা প্রত্যেককেই এটা মেনে নিয়েছি যে, দুই বস্তুর মধ্যে একটা অদৃশ্য শক্তি রয়েছে যা তাদেরকে একে অপরের থেকে ছিটকে যেতে দিচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথ এই টানের ব্যাপারটি বোঝাতে গিয়ে এক আশ্চর্যের বিষয় বলেছেন- “আলো বা উত্তাপ পথের বাধা মানে, কিন্তু মহাকর্ষতা মানে না। একটা জিনিসকে আকাশে ঝুলিয়ে রেখে পৃথিবী আর তার মাঝখানে যত বাধাই রাখা যাক না তার ওজন কমে না। ব্যবহারে অন্য কোনো শক্তির সঙ্গে এর মিল পাওয়া যায় না।”
রবীন্দ্রনাথের ভালো বন্ধু ছিলেন আইনস্টাইন। এই টানের শক্তির কথা বলতে গিয়ে তিনি আইনস্টাইনের যুক্তির অবতারণা করেছেন। আইনস্টাইনের দেখিয়ে দিলেন যে আমরা যেটিকে শক্তি বলে ভাবছি তা আসলে শক্তি নয়।
আমরা এমন এক বিশ্বব্রম্ভান্ডে বাস করি যেখানে প্রত্যেক বস্তুই নিজের দিকে টানে। বস্তুমাত্র যে আকাশে থাকে তার একটা বাঁকানো গুণ আছে। মহাকর্ষে তারই প্রকাশ। এই বিষয়টি সর্বব্যাপী এটা পরিবর্তন করা যায় না। এমনকি আলোকশক্তি ও এই নিয়ম মেনে চলতে হয়। মহাকর্ষ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন “যাই হোক, ইংরেজিতে যাকে গ্রাভিটেশন বলে তাকে মহাকর্ষ না বলে ভারাবর্তন নাম দিলে গোল চুকে যায়।”
পরিশেষে বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আলোচ্য অংশে মহাকর্ষজ টানের বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দর ভাবে উপস্থাপিত করেছেন। শুধু তাই নয়, সাহিত্যের সঙ্গে বিজ্ঞানকে একত্রে মিলিত করে এমন ভাবে উপস্থাপনা করেছেন যাতে আমাদের মহাকাশ সম্বন্ধে ধারণাকে জানবার আগ্রহকে দ্বিগুণ করে তুলেছে।

Post a Comment

0 Comments