রবীন্দ্রনাথের সুর দাসের প্রার্থনা কবিতায় যে সৌন্দর্যের চেতনা পরিচয় পাওয়া যায় তা আলোচনা করো।

 

রবীন্দ্রনাথের "সুরদাসের প্রার্থনা" কবিতায় যে সৌন্দর্যের চেতনা পরিচয় পাওয়া যায় তা আলোচনা করো।

অথবা 

সুরদাসের প্রার্থনা' কবিতাটির ভাববস্তু আলোচনা করো।


অথবা, 

'সুরদাসের প্রার্থনা' কবিতাটি অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য চেতনার স্বরূপ বিশ্লেষণ করো।


অথবা, 

'সুরদাসের প্রার্থনা' কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথের কাব্য-দশর্নের প্রতিফলন ঘটেছে- আলোচনা করো।


সুরদাসের প্রার্থনা' কবিতাটি প্রেম ও সৌন্দর্যানুভূতির ক্রমপরিণতির ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে আনে। সুরদাস ছিলেন হিন্দি সাহিত্যের একজন বিখ্যাত কবি। তাঁর মধ্যে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ছিল প্রবল। জনশ্রুতি আছে যে, ভক্ত সুরদাস একদা এক সুন্দরী নারীর রূপে আকৃষ্ট হন। শেষে একজন ভক্ত সাধকের পক্ষে এভাবে রমণীর প্রতি আসক্ত হওয়া ঘোরতর অপরাধ মনে করে তিনি একটি শলাকা দ্বারা চক্ষু উৎপাটন করেন।
অতি সহজেই অনুমেয় যে, এই কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ সুরদাসকে অবলম্বন করেই রচনা করেন এবং সুরদাসের মাধ্যমে সৌন্দর্য সম্বন্ধে তাঁর নিজস্ব ভাবানুভূতি প্রকাশ করেন। সমস্ত সৌন্দর্যের মধ্যে যে এক অন্তশায়ী সৌন্দর্যের আদি অখন্ডরূপ আছে, তারই প্রতি আকাঙক্ষা এই কবিতায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যানুভূতির বৈশিষ্ট্য এই যে, বিশ্বের সমস্ত সৌন্দর্য তিনি নারী দেহে কেন্দ্রীভূত হতে দেখেছেন। নারীই বিশ্ব সৌন্দর্যের মূর্তিমতি প্রতীক। কিন্তু নারীদেহের সঙ্গে একটি আদিম ভোগ-সংরস্কার চিরন্তভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। এই ভোগ-সংস্কারকে দূর করে সৌন্দর্যের মালিন্যহীন আদি বিশুদ্ধ রূপকে উপলব্ধি করার জন্য যুবক কবির মধ্যে যে দোলাচল চিত্তের সৃষ্টি হয়েছে, তারই প্রকাশ আছে মানসীর বিভিন্ন কবিতায়।
'সুরদাসের প্রার্থনা'য় নারীদেহে সৌন্দর্যের অভ্যন্তরে যে অমৃত সৌন্দর্যসত্তা, যা ইন্দ্রিয়জ ভোগের অতীত- সেই বিশুদ্ধ সৌন্দর্যে স্থিতি লাভ করবার জন্য কবি কামনা করেছেন।
সুরদাসের মাধ্যমে কবি সুন্দরী নারীর কাছে তাঁর চিত্ত বিকাশের কথা নিবেদন করেছেন। নারীর সীমাহীন রূপ তাঁর অন্তরে সম্ভোগ-বাসনা জাগ্রত করেছিল। তিনি লালসা তাড়িত হয়ে তাঁর দিকে চেয়েছিলেন। তাই অনুশোচনার তীব্র জ্বালা এবং তার অপরাধ সে অকপটে ব্যক্ত করেছে।
'অনিয়াছি ছুরি তীক্ষ্ণ দীপ্ত / প্রভাত রশ্মি সম- লও, বিঁধে দাও বাসনা সঘন / এ
কালো নয়ন মম।'
এই দেবীর কাছে কবির প্রার্থনা, তার পূর্ণ জ্যোতির স্পর্শে যেন কবির পাপরাশি ভস্মীভূত হয়ে যায়। স্বর্গবাসিনী গঙ্গার ন্যায় এই স্বর্গের দেবীও করুণা বিতরণের জন্য মানবী মূর্তিরূপে ধরায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এই দেবীর করুণায় কবির পাপ চিরতরে ধৌত হয়ে যাবে। তাই কবি বলতে পারেন-
'হৃদয় আকাশে থাক্ না জগিয়া দেহহীন তব জ্যোতি।'
বিচিত্রসৌন্দর্যমণ্ডিত ধরণীর মধ্য হতে যেন এক অপূর্ব মায়াময়ী সুন্দরী বের হয়ে তার যৌবনের, লাবণ্যের বাহুবন্ধনে কবিকে আলিঙ্গন করে। সমস্ত সৌন্দর্যের মূলে যে রূপাতীত অপার্থিব, অখন্ড সৌন্দর্য আছে; সেই চিরন্তন আনন্দের স্বপ্নকে কবি ভুলে যান। তাই তাঁর কাব্য সঙ্গীতে সেই প্রসঙ্গে বছরের পর বছর ধরে প্রকাশ পায় না। তবুও কবি চক্ষুহীনতাকে কামনা করেছেন। আঁখির অভাবে নিরবিচ্ছিন্ন অন্ধকারের অসীম অনুভূতির মধ্যে জগতের অস্তিত্ব আর থাকবে না। কেবল তাই নয়, সেই বিশ্ববিলোপী জগতের মধ্য থেকে জেগে উঠবে এক নতুন আলো, এক নতুন সত্তা, এক নির্মল- শুভ্র সংযত চেতনা-যে চেতনার পথ ধরে কবির সঙ্গে মিলন ঘটবে কবি প্রিয়ার, যে প্রিয়ার অপেক্ষায় কবি অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে বসে আছেন। তাই কবি অপসৃয়মান সৌন্দর্যের জগৎকে উপেক্ষা করে এবং আপন চক্ষুদ্বয়কে অন্ধ করে সেই অন্ধত্বের স্মৃতিপটে প্রিয়ার ছবি দেখতে চেয়েছেন। তাই কবির বাসনা-
'তোমাতে হেরিব আমার দেবতা, হেরিব আমার হরি- তোমার আলোকে জাগিয়ে রহিব অনন্ত বিভাবরী।'
'মানসী' কাব্য থেকে এই দেখার জগৎ শুরু হয়েছে। এখান থেকেই কবি রূপ থেকে রূপাতীতের পথে, খন্ড থেকে বৃহৎ এর পথে, সীমা থেকে অসীমের পথে এবং সর্বোপরি দেহ থেকে দেহাতীতের পথে যাত্রা করেছেন। আর সে যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ- 'সুরদাসের প্রার্থনা' এখানেই কবিতাটির সার্থকতা।



Post a Comment

0 Comments