বিশ্বপরিচয়' গ্রন্থে নক্ষত্রলোক প্রবন্ধে নক্ষত্রজগতের যে স্বরূপ রবীন্দ্রনাথ চিত্রিত করেছেন তা সংক্ষেপে আলোচনা করো।
উত্তর:- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'বিশ্বপরিচয়' প্রবন্ধে তাঁর বিজ্ঞান ও মহাবিশ্ব চেতনার পরিচয় দিয়েছেন। প্রবন্ধের ‘নক্ষত্রলোক' প্রবন্ধে নীহারিকা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।
শুরুতেই তিনি বলেছেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আসল চেহারা কী তা জানবার জো নেই। বিশ্বপদার্থের নিতান্ত অল্পই আমাদের চোখে পড়ে। তাছাড়া আমাদের চোখ, কান, স্পর্শেন্দ্রিয়ের নিজের বিশেষত্ব আছে। তাই বিশ্বের পদার্থগুলি বিশেষ ভাবে বিশেষরূপে আমাদের কাছে দেখা দেয়। রাত্রের আকাশে মাঝে মাঝে নক্ষত্রপুঞ্জের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় লেপে দেওয়া আলো। তাদের নাম দেওয়া হয়েছে নীহারিকা। এদের মধ্যে কতকগুলি অতি হালকা গ্যাসের মেঘ, আবার কতকগুলি নক্ষত্রের সমাবেশ। দূরবীনে এবং ক্যামেরার যোগে জানা গেছে যে, যে-ভিড় নিয়ে এই শেষোক্ত নীহারিকা, তাতে যত নক্ষত্র জমা হয়েছে, বহু কোটি তার সংখ্যা, আশ্চর্য দ্রুত তাদের গতি। এই যে নক্ষত্রের ভিড় নীহারিকামণ্ডলে অতি দ্রুতবেগে ছুটছে, এরা পরস্পর ধাক্কা লেগে চুরমার হয়ে যায় না কেন- এ প্রশ্ন রবীন্দ্রনাথের মনে উদয় হয়েছে। উত্তর তিনি নিজেই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন এ প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগে চৈতন্য। নীহারিকাগুলির মধ্যে গলাগলি ঘেঁষাঘেষি একেবারেই নেই। পরস্পরের কাছ থেকে অত্যন্তই দূরে দূরে এরা চলাফেরা করছে। পরমাণুর অন্তর্গত ইলেকট্রনদের গতিপথের দূরত্ব সম্বন্ধে স্তর জেমস্ জীনস্ যে উপমা দিয়েছেন এই নক্ষত্রমণ্ডলীর সম্বন্ধেও অনুরূপ উপমাই তিনি প্রয়োগ করেছেন। লন্ডনের ওয়াটলু নামে এক মস্ত স্টেশন আছে। যতদূর মনে পড়ে সেটা হাওড়া স্টেশনের চেয়ে বড়োই। স্তর জেমস জীনস্ বলেন সেই স্টেশন থেকে আর সব খালি করে ফেলে কেবল ছটি মাত্র ধুলোর কণা যদি ছড়িয়ে দেওয়া যায় তবে আকাশে নক্ষত্রদের পরস্পর দূরত্ব এই ধূলিকণাদের বিচ্ছেদের সঙ্গে কিছু পরিমাণে তুলনীয় হতে পারবে। তিনি বলেন, নক্ষত্রের সংখ্যা ও আয়তন যতই হোক আকাশের অচিন্তনীয় শূন্যতার সঙ্গে তার তুলনাই হতে পারে না'। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন, সৃষ্টিতে রূপবৈচিত্র্যের পাল। আরম্ভ হবার অনেক আগে কেবল ছিল একটা পরিব্যাপ্ত জ্বলন্ত বাষ্প। গরম জিনিস মাত্রেরই ধর্ম এই যে ক্রমে ক্রমে সে তাপ ছড়াতে থাকে। ফুটন্ত জল প্রথমে বাষ্প হয়ে বেরিয়ে আসে। ঠান্ডা হতে হতে সেই বাষ্প জমে হয় জলের কণা। অত্যন্ত তাপ দিলে কঠিন পদার্থও ক্রমে যায় গ্যাস হয়ে, সেইরকম তাপের অবস্থার বিশ্বের হালকা ভারি সব জিনিসই ছিল গ্যাস। কোটি কোটি বছর ধরে কালে কালে ঠান্ডা হচ্ছে। তাপ কমতে কমতে গ্যাস থেকে ছোটো ছোটো টুকরোতে ঘন হয়ে ভেঙে পড়েছে। এই বিপুল সংখ্যক কণা তারার আকারে জোট বেঁধে নীহারিকা গড়ে তুলছে।
যুরোপীয় ভাষায় এদের বলে নেবুলা, বহুবচনে নেবুলে। আমাদের সূর্য আছে এই রকম একটি নীহারিকার অন্তর্গত হয়ে। আমেরিকার পর্বতচূড়ায় বসানো হয়েছে মস্ত বড়ো এক দূরবীন, তার ভিতর দিয়ে খুব বড়ো এক নীহারিকা দেখা গেছে। সে আছে অ্যান্ডোমীড নামধারী নক্ষত্রমণ্ডনীর মধ্যে। ঐ নীহারিকার আকার অনেকটা গাড়ির চাকার মতো। সেই চাকা ঘুরছে। একপাক ঘোর শেষ করতে তার লাগে প্রায় দুকোটি বছর। নয় লাখ বছর লাগে এর কাছ থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছতে। কোনো কোনো গ্যাসীয় নীহারিকার যে উজ্জ্বলতা সে তার আপন আলোতে নয়। যে নক্ষত্রগুলি তাদের মধ্যে ভিড় করে আছে তারাই ওদের আলোকিত করেছে। আবার কোথাও নীহারিকার পরমাণুগুলি নক্ষত্রের আলোককে নিজেরা শুষে নিয়ে ভিন্ন দৈর্ঘ্যের আলোতে তাকে চালান করে। নীহারিকার আর একটি বিশেষত্ব দেখতে পাওয়া যায়। তার মাঝে মাঝে মেঘের মতো কালো কালো লেপ দেওয়া আছে, নিবিড়তম তারার ভিড়ের মধ্যে এক-এক জায়গায় কালো ফাক। জ্যোতিষী বার্নার্ডের পর্যবেক্ষণে এমনতরো প্রায় একশো কালো আকাশপ্রদেশ দেখা দিয়েছে। বার্নার্ড অনুমান করেন এগুলি অস্বচ্ছ গ্যাসের মেঘ, ওর পিছনের তারাগুলিকে ঢেকে রেখেছে। কোনোটা কাছে, কোনোটা দূরে, কোনোটা ছোটো, কোনোটা প্রকান্ড বড়। নক্ষত্রগুলির বেশি ভিড় নীহারিকার কেন্দ্রের কাছে।
পরিশেষে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের 'বিশ্বপরিচয়' প্রবন্ধে 'নক্ষত্রলোক' অংশে নীহারিকা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর এই বিবরণ মহাবিশ্ব সম্পর্কে আরো বেশি করে জানতে প্রতিটি পাঠককে উৎসাহিত ও অনুপ্রানীত করে।
0 Comments