নীলদর্পণ' নাটক অবলম্বনে আদুরী চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো।
অথবা, ‘নীলদর্পণ' নাটকে দাসী চরিত্রটির যে পরিচয় পাওয়া যায় তা লিপিবদ্ধ করো।
অথবা, গোলক বসুর পরিবারের পরিচারিকার নাম কী? নাটকের কাহিনির ক্ষেত্রে এই চরিত্রের গুরুত্ব বিচার করো। ২+৬=৮
উত্তর:-
দীনবন্ধু মিত্র 'নীলদর্পণ' নাটকে দুই শ্রেণির চরিত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। যথা—ভদ্র ও ভদ্রেতর চরিত্র। তিনি সচেতনভাবেই মুখের ভাষা দ্বারা এই দুই শ্রেণির চরিত্রকে পৃথক করে রেখেছেন। তবে দীনবন্ধুর কৃতিত্ব এই ভদ্রেতর শ্রেণির চরিত্র অঙ্কন। এক বিপুল অভিজ্ঞতা ও সহানুভূতি বোধ নিয়ে তিনি এই চরিত্রগুলি অঙ্কন করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন- “তাহার চরিত্র প্রণয়ন প্রথা এই ছিল যে, জীবন্ত আদর্শ সম্মুখে রাখিয়া চিত্রকরের ন্যায় চিত্র আঁকিতেন।” এমনকি তিনি আরও লিখেছেন - " সামাজিক বৃক্ষে বানর দেখিলে দীনবন্ধু লেজশুদ্ধ বানর অঙ্কন করিতেন।” সেই সহানুভূতির ফল তোরাপ, আদুরী, পদীময়রাণী চরিত্রগুলি।
আদুরী গোলক বসুর বাড়ির ভৃত্য। কিন্তু বাড়ির সবার সঙ্গে তার একটা আন্তরিকতার সম্পর্ক বিদ্যমান। তাকে আমরা প্রথম দেখি প্রথম অঙ্কের প্রথম গর্ভারেই। সে বাড়ির কর্তাদের জানাতে এসেছে অনেক বেলা হয়েছে, কখন তাঁরা আহার গ্রহণ করবেন। সৈরিন্ধী তাকে স্নেহবশত 'আদর' নামে ডাকে। প্রথম অঙ্কের চতুর্থ গর্ভাঙ্গে দেখি সৈরিন্ধী তাকে আনতে বলেছে তামাক পোড়ার কৌটা। সেই কৌটা আনতে সে গিয়েছে মই খুঁজতে। সৈরিন্ধী জানিয়েছিল রান্নাঘরের ডানদিকের বাতায় কৌটা গোঁজা আছে। আর তা খুঁজতেই আদুরির মই আনা। এখানে একটি গ্রাম্য পরিহাস আছে। সৈরিন্দী বলেছে ‘ডান দিক’, আর আদুরী বুঝেছে ‘ডান' অর্থাৎ ডাইনি। তাই সেও স্বভাবভঙ্গিতে উত্তর দেয়—“মুই ডান হতি গ্যালাম ক্যান। মোগার কপালের দোষ, গোরিব নোকের মেয়ে যদি বুড়ো হলো আর দাঁত পড়লো, তবেই সে ডান হয়ে ওটলো। মাঠাকুরুণরি বলবো দিনি, মুই কি ডান হবার মত বুড়ো হইচি।”
সৈরিন্ধী সরলতার কাছে বিদ্যাসাগরের ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি' শুনতে চেয়েছে। কিন্তু এই বিদ্যাসাগরের নাম আদুরী মেনে নিতে পারেনি। কেননা বিধবাবিবাহ তার পছন্দ নয়। সে গ্রাম্য মহিলা। গ্রাম্য সমাজের সমস্ত লোকাচার-সংস্কার তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। তাই সে বিধবাবিবাহ মেনে নিতে পারেনি। শুধু তাই নয় সে বিরুদ্ধ মত দিয়েছে। আত্মপক্ষ সমর্থনে জানিয়েছে—“সেই সাগর নাড়ের বিয়ে দেয়, ছ্যা—নাকি দুটো দল হয়েছে, মুই আজাদের দলে।” তেমনি সে পতিব্রতা নারী। স্বামী চলে যাওয়ার পরও সে অবৈধ সংসর্গে নিজেকে জড়ায়নি। সনাতন হিন্দু নারীর চিরকালীন সংস্কার নিয়ে আজও বেঁচে আছে। তাই সরলতার যখন প্রশ্ন করে স্বামী ভালোবাসত কি না, সে আবেগদীপ্ত কণ্ঠে জানিয়েছে—“মিনসের মুখখান মনে পড়লি আজো মোর পরাণড়া ডুকরো ক্যাদে ওটে। মোরে বড়ডি ভালো বাসতো। মোরে বাউ দিতে চেয়েলো।” তেমনি সে জানে স্বামীর নাম ধরতে নেই। তাই সরলতা প্রশ্ন করলে সে বিস্মিত হয়ে উত্তর দিয়েছে। সে নিজেও স্বামীর নাম ধরে ডাকেনি। সৈরিন্ধী প্রশ্ন করলে সে উত্তর দিয়েছে—“মোর মিনসের কথা সুদুচ্চেন তাই মুই বলতে লেগিছি।”
নিজের সতীত্ব সম্পর্কে আদুরী সর্বদা সচেতন। রেবতী জানিয়েছে ক্ষেত্রমণির ওপর চোখ পড়েছে ছোটো সাহেবের। আর সে সংবাদ দিয়ে গেছে পদীময়রাণী। কিন্তু আদুরী নিজের সহজ সরল ভঙ্গিতে জানিয়েছে নিজের ধর্মের কথা। সে ধর্ম নষ্ট করতে পারবে না। তেমনি সাহেবদের চরিত্র সে জানে। সাহেবদের শরীরে পিঁয়াজের গন্ধ। সেই সাহেবদের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সে জানায়- “খু, ঘু, থু। গোন্দো! প্যাজির গোন্দো। সাহেবের কাছে কি মোরা যাতি পারি, গোন্দো থু থু! প্যাজির গোন্দো। মুই তো আর একা বেরোব না, মুই সব সইতি পারি প্যাজির গোন্দো | সইতে পারি নে ...।” সাহেবের অত্যাচারে সে বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ করতে চেয়েছে। | তেমনি সাহেবদের বিবিদের সে দেখেছে। কিন্তু তাঁদের আচার-আচরণ সে সহ্য করতে পারেনি। স্ত্রীরা ঘোড়ায় উঠতে পারে এটা তার পক্ষে মানা সম্ভব নয়। এসব দৃশ্য তার অস্তরে আঘাত করে। পরিশেষে আদুরী সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য স্মরণ | করা যেতে পারে—“যাহা স্থূল, অসংগত, অংসলগ্ন, বিপর্যস্ত, তাহা তাঁহার ইতি মারেও | অধীন তাই আদুরী কিংবা পদীময়রাণীর মত তথাকথিত সমাজের নাম গোত্রহীন চরিত্রও তাঁর লিপিকৌশলে কঙ্কালে রক্তমাংস সঞ্জীবন করে প্রাণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।”
0 Comments