প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে মুদ্রা গুরুত্ব কতখানি। কিংবা এর সম্পর্কে আলোচনা করো।

 




**প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে মুদ্রা গুরুত্ব কতখানি। কিংবা এর সম্পর্কে আলোচনা করো।



•মুদ্রা প্রাচীন ভারত ইতিহাসের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।প্রাচীনকালে কাগজের প্রচলন ঘটেনি। স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান যুগের ন্যায় কাগুজে মুদ্রার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাই তখন বাণিজ্য ও জিনিসপত্র ক্রয়-বিক্রয়ের প্রধান মাধ্যম ছিল মুদ্রা। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত- ভাবে প্রাপ্ত অসংখ্য মুদ্রা ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে নব দিগন্তের উন্মোচন ঘটিয়েছে। ভারতবর্ষে বহু সহস্র মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে এবং বিভিন্ন যাদুঘরে সেগুলি সংরক্ষিত। আছে। মুদ্রাগুলিতে সাধারণত বাহীক (ব্যাকট্রীয়), সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাচীন ভারতের মুদ্রাগুলি প্রধানত সীসা, কাঁসা, তামা, রূপা ও সোনা দিয়ে তৈরি। ভারতে মুদ্রার ব্যবহার প্রথম কখন হয়েছিল তা আজ পর্যন্ত সঠিকভাবে নির্ধারিত হয়নি। তবে খননকার্যের ফলে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তক্ষশিলার ভীরমাউন্ডে প্রাপ্ত ছাপযুক্ত মুদ্রা (punch marked coin) গুলিকেই সর্বপ্রাচীন ভারতীয় মুদ্রা বলে মনে করা হয়। এগুলি নন্দ-মৌর্য আমলের। অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ তৃতীয় শতাব্দীর। এছাড়াও বাংলার মহাস্থানগড় (বগুড়া জেলা, বাংলাদেশ), বানগড় (দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা), মঙ্গলকোট (বর্ধমান জেলা) এবং চন্দ্রকেতুগড় (বেড়াচাপা, উত্তর চব্বিশ পরগণা) এ এই একই সময়ের বেশ কিছু ছাপযুক্ত মুদ্রা পাওয়া গেছে। মৌর্য্যোত্তর যুগে আনুমানিক খ্রিঃ পুঃ ১০০ অব্দ সময়কাল অবধি এই ধরনের মুদ্রা লক্ষ করা যায়। এই মুদ্রার প্রাচুর্যের পরিপ্রেক্ষিতে রামশরণ শর্মা প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা সিদ্ধান্তে এসেছেন যে উত্তর ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্যের সূচনা হয়েছিল এবং দ্রব্য বিনিময়ের পরিবর্তে মুদ্রার মাধ্যমে বিনিময় হত। বস্তুত, ধাতবমুদ্রা তৈরি ও প্রচলনের পর থেকেই বাণিজ্য ব্যবস্থা সহজতর হয়েছে।


•মৌর্যোত্তর কালে, বিশেষ করে গুপ্তযুগ পর্যন্ত ভারতের ইতিহাস জানার জন্য আমাদের অনেকখানি নির্ভর করতে হয় মুদ্রার ওপর। এই সময়কালেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুদ্রা পাওয়া যায়। এছাড়া এই সময় থেকেই প্রচলিত মুদ্রাগুলিকে নির্দিষ্ট রাজবংশের সঙ্গে শনাক্ত করা সম্ভব। কেননা, এভাবেই মুদ্রাগুলি উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখমালার ন্যার মুদ্রাও অতীত সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে স্বচ্ছ করে তোলে। এমন অনেক শাসক বা ঘটনার কথা আমরা জানি, যেগুলা মুদ্রার আবিষ্কার ছাড়া আমানো কাছে অজানা থেকে যেত।


•কোনো কোনো সময় অন্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য কোনো ঘটনার স্পষ্ট প্রমাণ দিতে অপারগ হয়। মুদ্রার সাহায্যে তা স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল, পশ্চিম ভারতে শকদের বিরুদ্ধে গুপ্ত শাসক দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের জয়লাভের ঘটনা। মাহদেশের ভিলসার নিকটবর্তী উপভাগিরিতে প্রাপ্ত তাঁর দুটি সেন এবং সাঁচীর লেখটি শতদের বিরুদ্ধে তাঁর মুখমাত্রার আভাস নেনা সত্য। তবে এর ফল কি হয়েছিল সে-স এগুলি নীরব। কিন্তু পশ্চিম ভারতে শক শাসকদের অনুকরণে দ্বিতী আনুমানিক ৪০১-৪১৩ খ্রিস্টাব্দে যে মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন তা অনেকটা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, এই যুদ্ধে তিনি সফল হয়েছিলেন। মলি হওয়ায় ৩৫ শাসক তাঁর রাজত্বকালের শেষদিকে পরদের পরাজিত করে উচ্চ ও পশ্চিম ভারতে প্রশাসন যে প্রতিষ্ঠা করেছি।


•১২-১৩ খ্রিস্ট। উক্ত মুদ্রা গুলি কিন্তু তথ্য থেকে অনুমান করা যে, ঐ তারিখের পরেও তিনি সু-এক বছর শাসন করেছিলেন। পরবর্তী শাসক প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বের সূচনার নিশ্চিত তারিখ ৪১ খ্রিস্টাপ হওয়ায় ঐ অনুমান স্পষ্টতর হয়। একইভাবে গৌতমীপুর সাতকর্ণী কর্তৃক শত শাসক নই পানের পরাজয়ের যে ইঙ্গিত রয়েছে সাতবাহনদের লেখমালায় তা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় দেখীতে প্রাপ্ত নহপানর একগুচ্ছ রৌপ্যমুদ্রা গৌতমীপুত্র কর্তৃক অনুকরণের পরিপ্রেক্ষিতে। এইভাবে মুদ্রা প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করে থাকে।



•ধর্ম ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস জানতেও মুদ্রার সাহায্য প্রয়োজন। মুদ্রা থেকেই জানা যায় যে, খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীর প্রথমার্ধে পার্থিয় বংশের শাসক গন্ডোফার্নেস এবং কুষাণ বংশের শাসক বিম কফিস বিদেশী হওয়া সত্ত্বেও ভারতে এসে শৈব ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, বিম কফিসের মুদ্রায় ব্যবহৃত 'মহেশ্বর' কথাটি থেকে মনে করা সম্ভব হয় যে, তিনি শৈব ছিলেন। কণিষ্কের কিছু মুদ্রায় বুদ্ধদেবের নাম ও মূর্তি অঙ্কিত থাকায় কণিষ্ক বৌদ্ধ ছিলেন—এই তত্ত্বটি সমর্থিত হয়। উল্লেখ্য, এদেশে কুষাণ শাসকরাই সর্বপ্রথম ব্যাপকহারে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন ঘটান। গুপ্ত শাসকদের মুদ্রার লক্ষ্মী ও কার্তিকের মূর্তি খোদিত থাকায় ঐ সমস্ত দেবদেবীর প্রতি তাদের আসক্তি প্রমাণিত হয়। আবার বৈষ্ণবধর্মের প্রতি গুপ্ত সম্রাটদের অনুরাগ প্রমাণিত হয় তাঁদের বেশ কিছু মুদ্রায় অঙ্কিত গরুড়ধ্বজের ছবি থেকে। এছাড়া প্রাচীন ভারতীয় স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রাগুলি থেকে প্রস্তুতকারকদের শিল্প-নৈপুণ্য ও সৌন্দর্যজ্ঞানের পরিচয় পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। মুদ্রার ওপর অঙ্কিত বিভিন্ন চিত্র থেকে সমসাময়িক কালে ব্যবহৃত পোশাক- পরিচ্ছদ, অস্ত্রশস্ত্র, বাদ্যযন্ত্র ও অলঙ্কার সম্বন্ধে আকর্ষণীয় তথ্য পাওয়া যায়।


•রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিক ছাড়াও একটি দেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত হতে মুদ্রা আমাদের অনেকখানি সাহায্য করে। কারণ কোনো মুদ্ৰা থেকে সংশ্লিষ্ট যুগের অর্থনৈতিক মান নির্ণয় করা সম্ভব। উন্নতমানের মুদ্রা যেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষণ, তেমনি হীনমানের মুদ্রা অর্থনৈতিক সংকটের নির্দেশক। বস্তুত, মুদ্রায় খাদের পরিমাণ হ্রাস-বৃদ্ধির ওপরেও সংশ্লিষ্ট যুগের উন্নতি-অবনতি নির্ভর করে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে,



 স্কন্দগুপ্তের সময় পর্যন্ত যে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বজায় ছিল তা বোঝা যায় সেই যুগের স্বর্ণমুদ্রা তথা উন্নতমানের মুদ্রাগুলি ও সমস্ত শ্রেণীর মুদ্রায় খাদের পরিমাণের স্বল্পতা দেখে। ঠিক এর বিপরীত- ভাবে পঞ্চম শতাব্দীর শেষ ও ষষ্ঠ শতাব্দীর গোড়ায় মুদ্রায় খাদের পরিমাণ বৃদ্ধি প্রমাণ করে যে, গুপ্ত যুগের শেষ দিকে অর্থনৈতিক সংকট মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। বাণিজ্যিক লেনদেন বোঝার ক্ষেত্রে মুদ্রার সাহায্য অপরিহার্য। কুষাণ যুগে ও শক সাতবাহন আমলে রোম তথা পাশ্চাত্যের সঙ্গে ভারতবর্ষের যে সমৃদ্ধশালী বাণিজ্য চলত তা ভারতে প্রাপ্ত ঐ সময়ের অসংখ্য রোমান মুদ্রা থেকে সমর্থিত হয়। এইভাবে দেখা যাচ্ছে যে, প্রাচীন ভারত ইতিহাসের যে-কোনো দিক সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে মুদ্রার সামগ্রিক বিশ্লেষণ একান্তই জরুরি।




Post a Comment

0 Comments