হর্ষবর্ধনের কৃতিত্ব আলোচনা করো।

 কনৌজপতি হর্ষবর্ধন : প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তি 'মহারাজাধিরাজ' হর্ষ শিলাদিত্য। বাণভট্টের 'হর্ষচরিত' এবং চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণীর মধ্য দিয়ে তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর বহুধাবিভক্ত ও ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ভারতবর্ষের পুনরায় বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা তথা রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা হর্ষবর্ধনের প্রধান কীর্তি।


🔴ঐতিহাসিক উপাদান: হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালের ইতিহাস জানতে হলে আমাদের প্রধানত কয়েকটি উপাদানের উপর নির্ভর করতে হয়- হর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্টের 'হর্ষচরিত', ও চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাঙ্-এর বিবরণ, সমসাময়িক লেখ ও জৈন কবি রবিকীর্তি রচিত 'আইহোল লেখ'। হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালের ঐতিহাসিক উপাদানগুলির নিরপেক্ষতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে, বিশেষ করে সাহিত্যিক উপাদানগুলির। সুতরাং এই উপাদানগুলি সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে।


🔴 হর্ষবর্ধনের সিংহাসন লাভ: উত্তর ভারতের ইতিহাসের সংকটময় মুহূর্তে হর্ষবর্ধন থানেশ্বর এবং কনৌজের অধীশ্বর হন। পিতা প্রভাকরবর্ধন দিল্লির নিকট থানেশ্বরে একটি ছোটো রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রাজ্যবর্ধন আনুমানিক ৬০৪ খ্রিস্টাব্দে থানেশ্বরের পৈতৃক সিংহাসনে আরোহণ করেন। মালবদেশের শাসক দেবগুপ্ত ও গৌড়রাজ শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনের ভগিনী রাজ্যশ্রীর স্বামী কনৌজরাজ গ্রহবর্মাকে যুদ্ধে পরাজিত এবং নিহত করে রাজ্যশ্রীকে কারাগারে বন্দি করলে রাজ্যবর্ধন তার প্রতিবিধান করতে অগ্রসর হন।

বাণভট্টের 'হর্ষচরিতে' এই ঘটনার যে বিবরণ আছে তা থেকে মনে হয় গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের 'বিশ্বাসঘাতকতা'-র জন্য রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু হয়েছিল। এভাবে থানেশ্বরের সিংহাসন শূন্য হয়ে পড়লে রাজ্যবর্ধনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা হর্ষবর্ধন ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে থানেশ্বরের সিংহাসনে অভিষিক্ত হন।

🔴 গৌড়রাজ শশাঙ্কের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যর্থতা: ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসন লাভের পর হর্ষের সম্মুখে দু'টি প্রধান কর্তব্য ছিল। প্রথমত, ভগিনী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করা; দ্বিতীয়ত, ভ্রাতা রাজ্যবর্ধনের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া। হর্ষবর্ধন কামরূপরাজ ভাস্করবর্মার সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেন। এভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে হর্ষ তাঁর উদ্দেশ্যসিদ্ধির পথে অগ্রসর হন। বিন্ধ্য পর্বতের অরণ্য অঞ্চল থেকে = রাজশ্রীকে উদ্ধার করে হর্ষ গৌড়ের অধিপতি শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হন। পূর্বদিক থেকে ভাস্করবর্মা ও পশ্চিমদিক থেকে হর্ষবর্ধন একযোগে শশাঙ্ককে আক্রমণ করেন কিন্তু শশাঙ্কের জীবিতকালে হর্ষের পক্ষে তাঁকে ন পরাজিত করা সম্ভব হয়নি। চূড়ান্ত তথ্যাদি থেকে জানা যায়, শশাঙ্ক ৬৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গৌড়বঙ্গে অপ্রতিহতভাবে তাঁর ক্ষমতা ভোগ করেছিলেন।

চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর নিকট পরাজয়: উত্তর ভারতে ক্ষমতা করে হর্ষবর্ধন দাক্ষিণাত্যে সাম্রাজ্য বিস্তারে অগ্রসর হয়েছিলেন। চালুক্যরাজাদের বিবরণ থেকে জানা যায় যে নর্মদা নদী পর্যন্ত তিনি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি এক বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে দক্ষিণ ভারত বিজয়ে অগ্রসর হন। কিন্তু ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে নর্মদা নদীর তীরে চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর সঙ্গে যুদ্ধে তিনি সুবিধা করতে পারেননি।


🔴 উত্তর ভারত জয়: দিগ্বিজয়ী হর্ষবর্ধন সমগ্র উত্তর ভারতে তাঁর
■ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। হস্তী এবং পদাতিক বাহিনীর বিশাল সমাবেশ দ্বারা হর্ষ তাঁর একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে হর্ষ তাঁর বিশাল বাহিনীর সাহায্যে সমগ্র উত্তর ভারতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যাঁরা তাঁর ক্ষমতা স্বেচ্ছায় স্বীকার করেননি, তিনি তাঁদের পদানত করেছিলেন।

সাম্রাজ্যের আয়তন: হর্ষের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি সম্বন্ধে নানা মতভেদ বর্তমান। ঐতিহাসিক পানিক্করের মতে, হর্ষের সাম্রাজ্য কামরূপ থেকে কাশ্মীর ও হিমালয় থেকে বিন্ধ্য পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
🔴 হর্ষই কি উত্তর ভারতের শেষ সম্রাট?: হর্ষকে অনেকেই উত্তর ভারতের সর্বশেষ সম্রাট বলে অভিহিত করেছেন ('সকলোত্তর পথনাথ') অর্থাৎ হর্ষ ছিলেন উত্তর ভারতের শেষ সাম্রাজ্যস্রষ্টা। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, এই উক্তিটি ভ্রান্ত। তিনি মনে করেন না যে উত্তর ভারতে হর্ষই সাম্রাজ্য বিস্তারের শেষ চেষ্টা করেছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর উত্তর ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের সকল প্রচেষ্টা নির্মূল হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে হর্ষের মৃত্যুর পর প্রায় পাঁচ শতাব্দী যাবৎ উত্তর ভারতে অনেক সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ঘটেছে। এদের কোনোটিই হর্ষের সাম্রাজ্যের অপেক্ষা ক্ষুদ্র ছিল না। গুর্জর প্রতিহার সাম্রাজ্য শুধু হর্ষের সাম্রাজ্যের চেয়ে বৃহত্তরই ছিল না, স্থায়িত্বের দিক থেকেও এটি দীর্ঘতর হয়েছিল। তথাপি বহুদিক থেকে তাঁর রাজত্বকাল ভারত ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

🔴 শাসন ব্যবস্থা: হর্ষবর্ধন প্রবর্তিত শাসন ব্যবস্থায় যদিও মৌর্য যুগের উৎকর্ষতা লক্ষ্য করা যায় না, তথাপি হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে তাঁর শাসন ব্যবস্থার উদার চরিত্র সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়। তিনি শাসনক্ষেত্রে মূলত গুপ্ত শাসন ব্যবসথাকে অনুসরণ করেছিলেন। বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিটি বিভাগ হর্ষ নিজে ব্যক্তিগতভাবে পর্যবেক্ষণ এবং পরিচালনা করতেন। নীতিগত শাসন ব্যবস্থা স্বেচ্ছাতন্ত্র হলেও জনসাধারণের হাতে স্বায়ত্তশাসনের অধিকারও ছিল। শাসনতান্ত্রিক কাজ ছাড়া এই মন্ত্রীপরিষদ রাজাকে উত্তরাধিকারী নিয়োগ ও পররাষ্ট্র নীতি রচনায় পরামর্শ দিত। হর্ষের শাসনকালে একটি সুগঠিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয়ের অস্তিত্ব জানা যায়। রাজ্যের কর্মচারীগণ 'মহাসামন্ত, মহারাজ, পরমতর, রাজস্থানীয়, কুমারমাত্য, বিষয়পতি নামে অভিহিত হতেন। হর্ষ তাঁর সাম্রাজ্যকে প্রদেশ, বিভাগ এবং জেলায় বিভক্ত করেছিলেন। প্রতিটি প্রদেশকে কতগুলি 'ভুক্তি' এবং প্রতিটি 'ভুক্তি'কে কতকগুলি 'বিষয়'-এ বিভক্ত করা হয়েছিল। রাজ্যে তিনপ্রকার কর ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। ভূমিরাজস্বকে বলা হতো 'ভাগ'। 'ভাগ' শস্যের দ্বারা দেওয়া হতো। ব্যবসায়ী বা কৃষকরা অর্থ দ্বারা যে কর দিত তাকে 'হিরণ্য' বলা হতো। অন্য একটি কর 'বলি' নামে অভিহিত ছিল। হর্ষের সময় প্রচলিত দণ্ডবিধি অনেক পরিমাণে লঘু ছিল। দৈহিক শান্তি প্রায় তুলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু হিউয়েন সাঙ্-এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, রাজ্যের পথঘাট সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিল না। চৈনিক পরিব্রাজক একাধিকবার ডাকাতের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন।


🔴 ধর্ম: ধর্মানুরাগ এর জন্য হর্ষবর্ধন সমগ্র ভারতের ইতিহাসে এক এক বিশেষ স্থান লাভ করেছিলেন তিনি সমস্ত ধর্মকে শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু তিনি আদিত্য ও অন্যান্য দেবদেবীর উপাসনা ও করতেন। সে জীবনে হর্স বৈধ ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়েছিলেন , বৈধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন কিন্তু সম্ভবত কোনদিন বৈধ ধর্ম গ্রহণ করেননি।

YouTube channel






Post a Comment

0 Comments