নীলদর্পণ নাটকটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করো


*নীলদর্পণ নাটকটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা,
 নীল দর্পণ নাটকটির সারমর্ম আলোচনা করো।
অথবা,
 নীল দর্পণ নাটকটির তুমি পড়ে কতটা সার্থকতা বুঝতে পেরেছ তা আলোচনা করো।


গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারে বোর্ডের কোশ্চেন কি টার্গেট করে এই প্রশ্নটি দিলাম অবশ্যই তোমরা উপকারের আসবে এটি আমাদের বিশ্বাস। আমাদের ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে সেখানে যুক্ত হওয়া এবং প্রতিনিয়ত কলেজের আপডেট এবং চাকরির আপডেটের সব পার আগে পেয়ে যাবে।



— বিষয়বস্তু বা সারসংক্ষেপ :
বাংলা সাহিত্যে এক উল্লেখযোগ্য নাটক হলো 'নীলদর্পণ' নাটক। এই নাটকটি নাট্যকারের বাস্তব অভিজ্ঞতার ফসল। নাটকটিতে স্বরপুর গ্রামের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত পরিবার গোলোকচন্দ্র বসুর পরিবারের কথা আছে। তার স্ত্রী সাবিত্রী পতিব্রতা ও আদর্শ গৃহণী। তার দুটি ছেলে বিন্দুমাধব ও নবীনমাধব।


 বিন্দুমাধবের স্ত্রী সরলতা ও নবীনমাধবের স্ত্রী সৈরিন্ধ্রী। জ্যেষ্ঠ নবীনমাধব সহৃদয় ও বলিষ্ঠ প্রকৃতির মানুষ। তিনি গ্রামেই থাকে। জমিজমা ও বিষয়সম্পত্তি দেখাশোন করে। আর অন্যদিকে নবীনমাধব কলেজে পড়াশুনা করেন। এই নাটকে আর একটি পরিবার হলো সাধুচরণ ও রাইচরণ। তার দুই ভাই গোলোকচন্দ্র বসুর অনুগত প্রতিবেশী রায়ত। রেবতী সাধুচরণের স্ত্রী ক্ষেত্রমণি তাদের একমাত্র সন্তান সে বিবাহিতা।
স্বরপুরের গ্রামের অদুরে রয়েছে ইংরেজ কুঠি। সেই কুঠির মালিক হলো আই আই উড্ ও পি পি রোগ সাহেব। তারা মুনাফার লোভে কর্মচারীদের সাহায্যে প্রজাদের ভালো জমি চিহ্নিত করে তাদের জোর করে নীলচাষ করতে বাধ্য করতো। আর প্রজারা যদি তাতে রাজি না হয়। তাহলে বলপূর্বক ভাবে রাজি করানো হয়। গ্রামের গরীব চাষিদের উপর নীলকরদের এরূপ অত্যাচার দেখে এগিয়ে এসেছে নবীনমাধব। এজন্য বসু পরিবারের প্রতি নীলকরসাহেবদের চরম আক্রোশ। বিগত বছর ৫০ বিঘা জমিতে বসু পরিবারকে নীলচাষ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু তারা তাদের পাওনা এখনো পায়নি। এইরকম অবস্থায় নীলকর সাহেবরা তাদের ৬০ বিঘা জমিতে নীলচাষ করতে বলেছে। এ অবস্থায় বসু পরিবারকে প্রায় অনাহারে থাকতে হবে।


 অনেক অনুরোধ করলেও কোনো লাভ হয়নি। বরং অপমানিত হতে হয়েছে।
সাধুচরণ ও রাইচরণ এই দুই ভাইয়ের ও মাথার উপর বজ্রাঘাত পড়ে। আমিন জমিতে দান দিতে এলে রাইচরণ তাতে বাধা দেয়। ফলে পেয়াদা এসে দুই ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। ছোট সাহেবের উপঢৌকন। হিসেবে তার নজর পড়ে ক্ষেত্রমণির উপর। সাধু ছোট সাহেবের কাছে। অনুরোধ করলেও কোনো ফল পায়নি। ফলস্বরপ চলেছে তার উপর।


 অকথ্য অত্যাচার। নবীনমাধব তাদের পক্ষে সুপারিশ করলে উড্ তীব্র ভাষায় অপমান করেন। গোপীনাথ নবীনকে বলে আপনি বাড়ি যান। অন্যদিকে বসুদের পারিবারিক জীবন সুখের স্বাচ্ছেন্দ্যের দাসী আদুরীর কথাবর্তা রসসিক্ত। সেখানে সাধুর স্ত্রী রেবর্তী এসে জানায় পদীময়রাণী জানিয়েছে ছোট সাহেবের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে ক্ষেত্রমণির উপর। আর তাই ছোট সাহেব ক্ষেত্রকে নিয়ে যেতে বলেছে। রেবতী আরও জানায় কুঠির সাহেবরা ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে যোগসাজসে কর্তামশাইয়ের দু'মাসের জেলের ব্যবস্থা করেছে। এইসব কথাবার্তা সাবিত্রীর শুনতে বিরক্ত লাগছিল। তাই সে রেবতীকে চলে যেতে বলে। এই প্রথম অংশের বিষয়বস্তু।




দ্বিতীয় অঙ্কে দেখা যায় বেগুনবেড়ের কৃঠির গুদাম ঘরে তোরাপ সহ চারজন রায়তকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। তাদের কথাবার্তায় জানা যায় যে নীলকরেরা এনেছে তাদের গোলোকের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তথা সাক্ষী দেওয়ার জন্য। কিন্তু তারা মন থেকে তা চায় না।


 কেননা গোলোক চন্দ্র বসু হলেন পরোপকারী ও প্রজাবৎসল। অথচ নীলকর সাহেবদের নির্মম অত্যাচারে তারা নীলকরদের বিরুদ্ধাচারণ করতে সাহস পায়নি। কিন্তু তাদের মধ্যে তোরাপ জানিয়েছে যে সে বিশ্বাস ঘাতকতা করতে পারবে না। আর অন্যদিকে তোরাপকে অন্যান্য রায়তরা মনে করিয়েছে -“শ্যামচাঁদের ঠ্যালা বড়ো ঠ্যালা।” দ্বিতীয় রায়ত বলে সাক্ষ্য না দিলে অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই নেই। এখানে প্রত্যেকটি রায়ত তাদের ওপর নীলকরদের অত্যাচার বর্ণনা একে একে তুলে ধরেছে। এর মধ্যে দেওয়ান গোপীনাথ সহ রোগ সাহেব তোরাপ ও অন্যান্য সকলের উপর নির্যাতন করতে থাকে। তোরাপ জল খেতে চাইলে তাকে কুটুক্তি করা হয়।



দ্বিতীয় গর্ভাঙ্কে বিন্দুমাধবের চিঠি পাঠরতা সরলতাকে আশা নিরাশায় দোলায়িত হতে দেখা যায়। গোলোক বসুকে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করবার চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে শহরে থেকে যেতে বাধ্য হচ্ছে জানালে, সাময়িক ভাবে বিরহ বেদনা ভারাক্রান্ত হলেও সে মানিয়ে নেয়। বিন্দু তাকে আশ্বাস দিয়েছে সরলতার প্রার্থিত বই সে অবশ্যই নিয়ে আসবে।



তৃতীয় গর্ভাঙ্কে পদীময়রাণীর স্থূলতা রসিকতা প্রকাশিত হয়েছে। নবীনকে দেখা যায় সে এখন পিতার ভবিষ্যৎ নি ভাবত। কারণ নবীন খুব ভালোভাবেই জানতো যে এই বয়সে পিতা জেল হলে পিতা কোনো ভাবেই বাঁচবেন না। অথচ নবীন কিছু করবে পারছে না। তার বিশ্বাস তোরাপ মিথ্যা সাক্ষ্য দিবে না। অথচ রায়ত যে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে পারে এই ভয়টা সে অস্বীকার করতে পারছে না। বিচারক ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট নীলকর সাহেবের বন্ধু। তাই বিচার ে শুধুমাত্র একটা প্রহসন মাত্র হবে সেটা নবীন খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে। এখানে নবীনকে আমরা এইসব কথা ভাবতে দেখে তাঁর ব্যাকুলত অনুভব করতে পারি। তিনি এতদিন যা ভাবেননি তাই ভাবছেন স্বপরিবারে তিনি ত্যাগ করেন। তবে পরোপকার ধর্ম পরিহার করবেন না। রায়তদের ওপর নীলকরদের অত্যাচার বাবার কথা ভেবে নবীনমাধবের মানসিক যন্ত্রনা এখানে Rising Action এর মতো ঘটনার গতি সঞ্চার করেছে। আ
তৃতীয়ত অঙ্কে দেখা যায় গোলোক বসুর ওপর ফৌজদারি পরোয়ানা গোপীনাথ উড্ সাহেবকে জানিয়েছে। এদিকে বসু পরিবারে এই খবর পৌঁছালে বাড়ির লোকেরা বিব্রত হয়ে পড়েছে।


 মোকদ্দমার জন্য নবীন মাধব এর হাতে প্রয়োজন ৫০০ টাকা। কিন্তু তার হাতে টাকা নেই। বাড়ির বউরা তাদের গয়না বিক্রির প্রস্তাব দিলে নবীন তাতে রাজি হয়নি। নবীন পূর্বের পরিস্থিতির সঙ্গে বর্তমানের পরিস্থিরিত তুলনা করে মনে মনে বেদনা বোধ করেন। এইরূপ পরিস্থিতির মধ্যে চিঠি মারফত ৩০০ টাকা পাওয়ার কথা জানতে পেয়ে সে আশ্বস্ত বোধ করেন। হঠাৎ রেবতী তাঁর কন্যা ক্ষেত্রমণির অপহরণের সংবাদ দেয়। নবীন মাধব শপথ করে যেমন করে হোক ক্ষেত্রমণিকে সে ফিরিয়ে আনবে। সাবিত্রীও ক্ষেত্রের অপবিত্র হওয়ার আগেই তাকে ফিরিয়ে আনার আদেশ প্রদান করে নবীনকে।



পদীময়রাণী ক্ষেত্রকে রোগের ঘরে বসিয়ে তাকে ব্যবসায় নামাবার জন্য বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করলেও ক্ষেত্র তার ধর্মকে বিসর্জন দিতে রাজি হয়নি। রোগ সাহেব বলপূর্বক শ্লীলতাহানীর চেষ্টা করলেও ক্ষেত্রমণি তার হাত আঁচড়িয়ে গ্রাম্য ভাষায় তাকে গালাগাল করতে থাকে। রোগসাহেব উত্তেজিত হয়ে গর্ভবতী ক্ষেত্রর পেটে ঘুষি ও মাথার চুল ধরে টানতে থাকে। এমন সময় নবীনমাধব ও তোরাপ রোগের কামরায় প্রবেশ করে ক্ষেত্রমণিকে উদ্ধার করে। তোরাপ সাহেবকে সজোরে আঘাত করে চলে যায়। দ্বিতীয় অঙ্কের বর্ণিত ঘটনা প্রবাহ এখানে সূচীমুখে প্রবেশ করেছে। সংঘর্ষের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। রোগ সাহেবের অত্যাচারের চরম দৃশ্য এক্ষেত্রে লক্ষণীয়, সেই সঙ্গে রয়েছে তাঁর তীব্রতর প্রতিবাদ। বসু পরিবারের হতাশার পরিবেশ বিরাজ করেছে। নবীন ইন্দ্রারাবাদে গিয়েছে গোলোককে মামলা থেকে মুক্ত করবার আশা নিয়ে।
চতুর্থ অঙ্কে নাটকের ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু হলো ইন্দ্রারাবাদ। চতুর্থ | অঙ্কে তিনটি গর্ভাঙ্কে সন্নিবিষ্ট রয়েছে ফৌজদারী কাছারী বিন্দুমাধবের বাসাবাড়ি এবং জেলখানা। আলোচ্য অংশে দেখা যায় গোলোক বসু পরিবারের মোক্তার বিচারক এর কাছে প্রার্থনা করেছেন যে গোলোক বসুর অনুপস্থিতিতে যাদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে তাদের পুনরায় হাজির করা হোক। কিন্তু নীলকরদের বেতনভোগী কর্মীরা এর বিরোধীতা করে। তারা জানায় নীলকরেরা এদেশে মঙ্গল সাধনের পাশাপাশি দেশের রাজকোষ বৃদ্ধিতে বিপুল পরিমাণ সাহায্য করেছে। তাই যারা এর বিরুদ্ধচারণ করবে তাদের কারাবাস করা উচিৎ। মোক্তার চরমহীনতার পরিচয় দিয়ে ধার্মিক নিরীহ গোলোক বসুর চরিত্র সম্বন্ধে ও কতগুলি মিথ্যা অভিযোগ করে। প্রতিবাদী মোক্তারের কোন তথ্য বা যুক্তি তাঁরা মানেন নি। বিচারকের আসনের পাশে উড় ও রোগ সাহেব বসে থেকে সময়োচিত মত ও মন্তব্য পেশ করে বিচারককে পক্ষপাত দুষ্ট করে তোলে। সর্বশেষে বিচারক মত দিলেন যে দুশো টাকা জরিমানায় গোলোক বসুকে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। সেই সূত্রে ডেপুটি ইন্সপেক্টার কাছ থেকে জানা গেল কমিশনার সুপারিশ করেছেন গর্ভনর সাহেবের অনুমোদন ক্রমে গোলোক বসুর মুক্তির ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি গোলোকের কাছে এই সিদ্ধান্ত ছিল চরম অপমানকর। সৎ ন্যায়পরায়ণ এই মানুষটি মেনে নিতে পারেন নি। নবীনমাধবের কাছে ও এই এক চরমতর সংকটময় মুহূর্ত। নবীনমাধব স্থির করেন সবকিছুই বেঁচে পিতার মুক্তির ব্যবস্থা করবেন। এরই মধ্যে বিন্দুমাধবের বাড়িতে বার্তা আসে জেলে দারোগা তাকে শীঘ্রই উপস্থিত হবার জন্য অনুমতি জানিয়েছেন। বিন্দুমাধব জেলে গিয়ে দেখেন গোলোক অপমানের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন অর্থাৎ তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
নাটকের শেষ অঙ্ক পঞ্চমাঙ্কে বেগুননবেড়ের কুঠিতে গোপীনাথ ও একজন উমেদারের কথোপকথনে জানা যায় যে বসু পরিবার যথেষ্ট সম্ভ্রান্ত উদার ও পরোপকারী। গোলোক বসুর মৃত্যুতে গোপীনাথের মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য কিঞ্চিৎ আত্ম অনুশোচনা লক্ষ্য করা যায় এখানে। সে তাই উডুকে সরকিওয়ালা নিয়ে নবীনমাধবদের পুকুর পাড়ের জমিতে নীল বোনা থেকে নিরস্ত করতে চেয়েছে। এদিকে উড্ সাহেব নবীনমাধবের অশৌচের সুযোগকে হাতিয়ার করেছে।



দ্বিতীয় গর্ভাঙ্কে উড্ সাহেব ও রোগ সাহেব সরকিওয়ালাদের সঙ্গে নিয়ে নবীনমাধবদের জমিতে নীল বুনতে এলে তাকে ৫০ টাকা দিয়ে এ বছর নীল চাষ বন্ধ রাখবার অনুরোধ জানায়। পিতৃশ্রাদ্ধ পর্যন্ত যেন তা বন্ধ রাখা হয় তাঁর প্রার্থনা করে। কিন্তু উত্তরে উড্ অসঙ্গত মন্তব্য করলে নবীনমাধব রেগে গিয়ে তার বুকে পদাঘাত করে এবং সেই আঘাতেই নবীনের মৃত্যু হয়। অদূরে প্রতীক্ষমান তোরাপ বড় সাহেবের নাক কামড়ে নেয়। সাবিত্রী সৈরিন্ধ্রী, সরলতা নবীনমাধবের এহেন অবস্থা দেখে হাহাকার করে উঠে। আদুরী শোকে কাঁদতে আরম্ভ করে।

 আবার সাবিত্রী উন্মাদিনী হয়ে যায়।



সুতরাং ,একদিকে নীলকর সাহেবদের অত্যাচার তথা অনাচারের যেমন দৃশ্য কে নাট্যকার তুলে ধরেছেন ঠিক তেমনি ভারতবর্ষীয় মানুষের দুঃখ যন্ত্রনার নির্মম দলিল হয়ে উঠেছে এই নাটক।


Post a Comment

0 Comments