কবিতা
এবার ফিরাও মোরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সংসারে সবাই যবে সারাক্ষণ শত কর্মে রত, তুই শুধু ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মতো মধ্যাহ্নে মাঠের মাঝে একাকী বিষণ্ণ তরুচ্ছায়ে দূরবনগন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তপ্তবায়ে সারাদিন বাজাইলি বাঁশি। ওরে তুই ওঠ আজি; আগুন লেগেছে কোথা? কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি জাগাতে জগৎ-জনে? কোথা হতে ধ্বনিছে ক্রন্দনে শূন্যতল? কোন্ অন্ধকারামাঝে জর্জর বন্ধনে অনাথিনী মাগিছে সহায়? স্ফীতকায় অপমান অক্ষমের বক্ষ হতে রক্ত শুষি করিতেছে পান লক্ষ মুখ দিয়া; বেদনারে করিতেছে পরিহাস স্বার্থোদ্ধত অবিচার; সংকুচিত ভীত ক্রীতদাস লুকাইছে ছদ্মবেশে। ওই যে দাঁড়ায়ে নতশির মূক সবে—ম্লান মুখে লেখা শুধু শত শতাব্দীর বেদনার করুণ কাহিনী; স্কন্ধে যত চাপে ভার বহি চলে মন্দগতি, যতক্ষণ থাকে প্রাণ তার- তার পরে সন্তানেরে দিয়ে যায় বংশ বংশ ধরি, নাহি ভর্ৎসে অদৃষ্টেরে, নাহি নিন্দে দেবতারে স্মরি, মানবেরে নাহি দেয় দোষ, নাহি জানে অভিমান, শুধু দুটি অন্ন খুটি কোনোমতে কষ্টক্লিষ্ট প্রাণ রেখে দেয় বাঁচাইয়া। সে অন্ন যখন কেহ কাড়ে, সে প্রাণে আঘাত দেয় গর্বান্ধ নিষ্ঠুর অত্যাচারে, নাহি জানে কার দ্বারে দাঁড়াইবে বিচারের আশে-
দরিদ্রের ভগবানে বারেক ডাকিয়া দীর্ঘশ্বাসে মনে সে নীরবে। এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে দিতে হবে ভাষা—এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা—ডাকিয়া বলিতে হবে- মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে, যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে, যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে; যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তাহার, তখনি সে পথকুক্কুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে দেবতা বিমুখ তারে, কেহ নাহি সহায় তাহার, মুখে করে আস্ফালন, জানে সে হীনতা আপনার মনে মনে।
কবি, তবে উঠে এসো— যদি থাকে প্রাণ তবে তাই লহো সাথে, তবে তাই করো আজি দান। বড়ো দুঃখ, বড়ো ব্যথা–সম্মুখেতে কষ্টের সংসার বড়োই দরিদ্র, শূন্য, বড়ো ক্ষুদ্র, বন্ধ, অন্ধকার । অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু, চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু, সাহসবিস্তৃত বক্ষপট। এ দৈন্যমাঝারে, কবি, একবার নিয়ে এসো স্বর্গ হতে বিশ্বাসের ছবি।
এবার ফিরাও মোরে, লয়ে যাও সংসারের তীরে হে কল্পনে, রঙ্গময়ী! দুলায়ো না সমীরে সমীরে তরঙ্গে তরঙ্গে আর, ভুলায়ো না মোহিনী মায়ায় ৷ বিজন বিষাদঘন অন্তরের নিকুঞ্জচ্ছায়ায় রেখো না বসায়ে আর। দিন যায়, সন্ধ্যা হয়ে আসে। অন্ধকারে ঢাকে দিশি, নিরাশ্বাস উদাস বাতাসে নিশ্বসিয়া কেঁদে ওঠে বন। বাহিরিনু হেথা হতে উন্মুক্ত অম্বরতলে, ধূসরপ্রসর রাজপথে জনতার মাঝখানে। কোথা যাও, পান্থ, কোথা যাও
আমি নহি পরিচিত, মোর পানে ফিরিয়া তাকাও। বলো মোরে নাম তব, আমারে কোরো না অবিশ্বাস। সৃষ্টিছাড়া সৃষ্টিমাঝে বহুকাল করিয়াছি বাস সঙ্গিহীন রাত্রিদিন; তাই মোর অপরূপ বেশ, আচার নূতনতর, তাই মোর চক্ষে স্বপ্নাবেশ বক্ষে জ্বলে ক্ষুধানল। যেদিন জগতে চলে আসি, কোন্ মা আমারে দিলি শুধু এই খেলাবার বাঁশি। বাজাতে বাজাতে তাই মুগ্ধ হয়ে আপনার সুরে দীঘদিন দীর্ঘরাত্রি চলে গেনু একান্ত সুদূরে ছাড়ায়ে সংসারসীমা। সে বাঁশিতে শিখেছি যে সুর তাহারি উল্লাসে যদি বীতশূন্য অবসাদপুর ধ্বনিয়া তুলিতে পারি, মৃত্যুঞ্চয়ী আশার সংগীতে কর্মহীন জীবনের এক প্রান্ত পারি তরঙ্গিতে শুধু মুহূর্তের তরে, দুঃখ যদি পায় তার ভাষা, সুপ্তি হতে জেগে ওঠে অন্তরের গভীর পিপাসা স্বর্গের অমৃত লাগি—তবে ধন্য হবে মোর গান, শত শত অসন্তোষ মহাগীতে লভিবে নির্বাণ।
কী গাহিবে, কী শুনাবে। বলো, মিথ্যা আপনার সুখ, মিথ্যা আপনার দুঃখ। স্বার্থমগ্ন যেজন বিমুখ বৃহৎ জগৎ হতে সে কখনো শেখে নি বাঁচিতে। মহাবিশ্বজীবনের ভরলোতে নাচিতে নাচিতে নির্ভয়ে ছুটিতে হবে, সত্যেরে করিয়া মুবতারা। মৃত্যুরে করি না শঙ্কা। দুর্দিনের অশ্রুজলধারা মস্তকে পড়িবে ঝরি—তারি মাঝে যাব অভিসারে তার কাছে, জীবনসর্বস্বধন অপিয়াছি যারে জন্ম জন্ম ধরি। কে সে? জানি না কে। চিনি নাই তারে- শুধু এইটুকু জানি—তারি লাগি রাত্রি-অন্যকারে চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর পানে
ঝড়ঝঞ্ঝা-বজ্রপাতে, জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে অন্তরপ্রদীপখানি। শুধু জানি, যে শুনেছে কানে তাহার আহ্বানগীত, ছুটেছে সে নির্ভীক পরানে সংকট-আবর্তমাঝে, দিয়েছে সে বিশ্ব বিসর্জন, নির্যাতন লয়েছে সে বক্ষ পাতি; মৃত্যুর গর্জন শুনেছে সে সংগীতের মতো। দহিয়াছে অগ্নি তারে, বিদ্ধ করিয়াছে শূল, ছিন্ন তারে করেছে কুঠারে, সর্ব প্রিয়বস্তু তার অকাতরে করিয়া ইন্ধন চিরজন্ম তারি লাগি জ্বেলেছে সে হোম-হুতাশন— হৃৎপিণ্ড করিয়া ছিন্ন রক্তপদ্ম-অর্ঘ্য-উপহারে ভক্তিভরে জন্মশোধ শেষ পূজা পূজিয়াছে তারে মরণে কৃতার্থ করি প্রাণ। শুনিয়াছি তারি লাগি রাজপুত্র পরিয়াছে ছিন্ন কথা, বিষয়ে বিরাগী পথের ভিক্ষুক। মহাপ্রাণ সহিয়াছে পলে পলে সংসারের ক্ষুদ্র উৎপীড়ন, বিধিয়াছে পদতলে প্রত্যহের কুশাঙ্কুর, করিয়াছে তারে অবিশ্বাস মূঢ় বিজ্ঞজনে, প্রিয়জন করিয়াছে পরিহাস অতিপরিচিত অবজ্ঞায়, গেছে সে করিয়া ক্ষমা নীরবে করুণনেত্রে—অন্তরে বহিয়া নিরুপমা সৌন্দর্যপ্রতিমা। তারি পদে মানী সঁপিয়াছে মান, ধনী সঁপিয়াছে ধন, বীর সঁপিয়াছে আত্মপ্রাণ; তাহারি উদ্দেশে কবি বিরচিয়া লক্ষ লক্ষ গান ছড়াইছে দেশে দেশে। শুধু জানি তাহারি মহান গম্ভীর মঙ্গলধ্বনি শুনা যায় সমুদ্রে সমীরে, তাহারি অঞ্চলপ্রাত্ত লুটাইছে নীলাম্বর ঘিরে, তারি বিশ্ববিজয়িনী পরিপূর্ণা প্রেমমূর্তিখানি বিকাশে পরমক্ষণে প্রিয়জনমুখে। শুধু জানি সে বিশ্বপ্রিয়ার প্রেমে ক্ষুদ্রতারে দিয়া বলিদান বর্জিতে হইবে দূরে জীবনের সর্ব অসম্মান;
সম্মুখে দাঁড়াতে হবে উন্নত মস্তক উচ্চে তুলি যে মস্তকে ভয় লেখে নাই লেখা, দাসত্বের ধূলি আঁকে নাই কলঙ্কতিলক। তাহারে অন্তরে রাখি জীবনকণ্টকপথে যেতে হবে নীরবে একাকী, সুখে দুঃখে ধৈর্য ধরি, বিরলে মুছিয়া অশ্রু-আঁখি, প্রতিদিবসের কর্মে প্রতিদিন নিরলস থাকি, সুখী করি সর্বজনে। তার পরে দীর্ঘপথশেষে জীবনযাত্রা-অবসানে ক্লান্তপদে রক্তসিক্ত বেশে উত্তরিব একদিন শ্রান্তিহরা শাস্তির উদ্দেশে দুঃখহীন নিকেতনে। প্রসন্নবদনে মন্দ হেসে পরাবে মহিমালক্ষ্মী ভক্তকণ্ঠে বরমাল্যখানি, করপদ্মপরশনে শান্ত হবে সর্ব দুঃখমানি সব অমঙ্গল। লুটাইয়া রক্তিম চরণতলে ধৌত করি দিব পদ আজন্মের রুদ্ধ অশ্রুজলে। সুচিরসঙ্কিত আশা সম্মুখে করিয়া উদ্ঘাটন জীবনের অক্ষমতা কাঁদিয়া করিব নিবেদন, মাগিব অনন্ত ক্ষমা। হয়তো ঘুচিবে দুঃখনিশা, তৃপ্ত হবে এক প্রেমে জীবনের সর্বপ্রেমভূষা।
0 Comments