ধর্মমঙ্গলকে রাঢ়ের জাতীয় মহাকাব্য বলা কতটা মুক্তিযুক্ত আলোচনা করো ।

* ধর্মমঙ্গলকে রাঢ়ের জাতীয় মহাকাব্য বলা কতটা মুক্তিযুক্ত আলোচনা করো ।



ধর্মমঙ্গলের প্রথম কাহিনী - দ্বিতীয় কাহিনী - ধর্মঠাকুরের কৃপা ধর্মঠাকুরের মূর্তি প্রসঙ্গ উপসংহার


উ: ভূমিকা :


বাংলাদেশে ধর্মঠাকুরকে কেন্দ্র করে যে কাস্ট বা উপসম্প্রদায় উদ্ভব হয়েছে, তাদের সম্প্রদায়গত পরিচয় বিস্ময়কর, তেমনি তাদের সাহিত্য বিচিত্র ও অভিনব তথ্যে পরিপূর্ণ। ধর্মমঙ্গল কাব্যে ধর্মঠাকুর পরিকল্পনা মূলতঃ অস্ট্রিক, ভাবনাজাত। পরবর্তীকালে বাংলা বৌদ্ধ ব্রাহ্মণ্য এবং ইসলামি সংস্কৃতির চিন্তা ঘটলে তা ধর্মঠাকুরের ঐতিহ্যের অঙ্গীভূত হয়ে যায়। 'মনসামঙ্গল' কাব্য যেমন পূর্ববঙ্গের লোকগাথা, 'ধর্মমঙ্গল'ও তেমন রায় বা পশ্চিমবঙ্গের লোকগাঁথা।


ধর্মীয় অনুবর্তন:


মধ্যযুগের ধর্মীয় প্রথানুবর্তনের পথ ধরে 'ধর্মমঙ্গল' কাব্যের সৃষ্টি হলেও এতে বাস্তব জগতের সাহসিক কীর্তিকলাপ ও রাষ্ট্রীয় সংঘাতের বর্ণাঢ্য পরিচয় লিপিবদ্ধ। অর্থাৎ লোক জীবনের রুক্ষতা, স্থূল গ্রাম্যতা, শৌর্য-বীর্য, রাষ্ট্রবিপ্লব, সংঘাত-সংঘর্ষ, বঞ্চনা-চক্রান্ত এবং অতি প্রাকৃত ঘটনা বিস্তারে 'ধর্মমঙ্গল' কাব্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়।


ধর্মঠাকুরের বিভাগ


প্রকৃতপক্ষে বাংলা সাহিত্যে ধর্মঠাকুর সংক্রান্ত রচনাগুলি প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত— ১. রামাই পণ্ডিতের শূন্যপুরাণ এবং ২. ধর্মমঙ্গল কাহিনী কাব্য। এই কাব্যের আবার দুটি কাহিনী সন্নিবেশিত— ক. রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনী। এবং খ. ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বীর লাউসেনের কাহিনী।


ধর্মমঙ্গলের প্রথম কাহিনী:


প্রথম কাহিনীটি নিঃসন্তান রাজা হরিশ্চন্দ্র ও রানী মদনার সন্তান লাভ এবং শেষ পর্যন্ত রাজার প্রতিশ্রুতি পালনের জন্য নিজের পুত্র লুইধরকে বলি দিয়ে তার মাংস রন্ধন করে অতিথি ধর্মঠাকুরকে নিবেদন করলে তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে ধর্মঠাকুর লুইধরকে পুনরুজ্জীবিত করেন এবং রাজা-রানী সাড়ম্বরে ঠাকুরের পূজা আরম্ভ করেন।


দ্বিতীয় কাহিনী:


দ্বিতীয় কাহিনী লাউসেনের বীরত্বকেন্দ্রিক এবং এটি অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের মত ধর্মীয় চেতনায় পুষ্ট। ধর্মঠাকুর মর্ত্যে পূজা প্রচার মানসে স্বর্গের নর্তকী জাম্ববতীকে রমতি নগরে রঞ্জাবতী হিসেবে পাঠান। তাঁর জ্যেষ্ঠা ভগিনী গৌড়েশ্বরের রানী এবং অগ্রজ মহামদ গৌড়ের প্রধান অমাত্য। ঢেকুরগড়ের অধিপতি রাজা কর্ণসেনের সঙ্গে গৌড়েশ্বর নিজ শালিকা রঞ্জাবতীর বিবাহ দেন।


ধর্মঠাকুরের কৃপা :


শেষপর্যন্ত ধর্মঠাকুরের কৃপায় রঞ্জাবতী এক শাপভ্রষ্ট দেবতাকে পুত্ররূপে পান। এই লাউসেনই বীরত্বে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। মহামদের চক্রান্ত তাঁকে পর্যুদস্ত করতে পারে নি। শেষ পর্যন্ত মহামদ শাস্তি পান। মহাপাপের জন্য মহামদের কুষ্ঠব্যাধি হয়। কিন্তু দয়াপরবশ হয়ে লাউসেন মহামদকে কঠিন ব্যাধি থেকে উদ্ধার করেন ধর্মের কৃপায়। মর্ত্যলোকে ধর্মের পূজা প্রচারিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত পরম গৌরবে রাজত্ব করার পর পুত্র চিত্রসেনের হাতে সিংহাসন দিয়ে লাউসেন স্বর্গারোহন করেন।


ধর্মঠাকুরের মূর্তি প্রসঙ্গ।


ধর্মপূজা জাগ্ৰত পূজা, ধর্মোৎসব পশ্চিমবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের কিয়দংশের সামাজিক উৎসব। বাংলাদেশের অধিকাংশ স্থলে ধর্মপূজায় মূর্তি ব্যবহৃত হয় না। স্থানে স্থানে তাঁর শিলামূর্তি (একখণ্ড পাথর— কোথাও ডিম্বের আক কোথাও চৌকো, কোথাও বা গোলাকার কর্মমূর্তি) পূজা হয়। শূনপুরাণের বহুস্থলে ধর্মঠাকুরকে শূন্যমূর্তি বলা হয়েছে।


শূন্যরূপা নিরাকারং সহস্রবিঘ্নাবিনাশনম্। সর্ব্বপরঃ পরো দেব তস্মাৎ তুং বরদো এব।।”


এ প্রসঙ্গে ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন— “ধর্মঠাকুরের কোন মূর্তি নাই। তাহার পরিবর্তে একখণ্ড স্বাভাবিক প্রস্তরই এই নামে পূজিত হয়। ....... ধর্মঠাকুরের অন্য কোন প্রতিমা নাই।”


উপসংহার:-


সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজবৃত্তের পর প্রতিক্রিয়া পরায়ণ হিন্দু ধর্মাবলম্বী সেন রাজবৃত্তের ক্ষমতালাভের সঙ্গে সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের উপর প্রাধান্য তথা প্রভাব সত্ত্বেও সেন শাসনকালে ধর্মঠাকুরের উত্থান হয়েছে বলে পণ্ডিতরা মনে করেন। লৌকিক ধর্মপূজার পুরোহিতরা সেদিন ব্রাহ্মণ সংস্থার দ্বারা নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন বলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহের অভিমত। হিন্দুধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের শূন্যবাদের মিশ্রণজাত এই ধর্মে শেষ পর্যন্ত ইসলামিক ধর্মের প্রবর্তনাও মিশে যায়। সেই কারণে ধর্মমঙ্গল কাব্যে বর্ণবিরোধ নেই, মানবের প্রবল হিংসা নেই। আছে উচ্চ-নিম্ন বর্ণের মেলামেশা ও আচার সংসারের সহযোগিতার ভাব। এটি রাঢ়ের বা পশ্চিমবঙ্গের লোকগাথা। এর কাব্যের গঠনে রাঢ় অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি এবং মহাকাব্যের বীররসাত্মক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তাই অনেক সমালোচক একে রাঢ়ের জাতীয় মহাকাব্য বলে আখ্যা দিয়েছেন।

Post a Comment

0 Comments