•প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে রামায়ণ ও মহাভারতের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করো।
•ভূমিকা:-
রামায়ণ ও মহাভারত সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে বহু দিক বহু দিক নজর দিতে হয়। যথা- বিভিন্ন ঘটনা কারণ ।এবং পুরান সমন্বিত বাস্তব রূপ। রামায়ণ ও মহাভারত কে ছোট লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সংস্কৃত ভাষায় লেখা এই গ্রন্থ দুটি কেবল উপাদান হিসেবে নয় সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসেও একটি বিরাট সম্পদ। কাব্য দুটি সম্পর্কে পৃষ্ঠাগ ভাবে আলোচনা করা হয়েছে নিচে।
•রামায়ণ:-
রামায়ণের কিছু তথ্য:- রামায়ণের কাহিনীর উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় হবে। অযোধ্যার রাজা দশরথের জ্যেষ্ঠ পুত্র রাম। তাঁকে কেন্দ্র করেই রামায়ণের মূল ঘটনাস্রোত প্রবাহিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন বিদেহ রাজকুমারী সীতার সঙ্গে। রামচন্দ্রের বিমাতার একান্তই ইচ্ছা ছিল তাঁর নিজ পুত্র ভরতকে সিংহাসনে বসানো, যদিও প্রকৃত উত্তরাধিকারী ছিলেন রামচন্দ্র। তাঁরই কৌশলে রামচন্দ্র স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করেন এবং রাম, সীতা ও রামের একান্ত অনুগামী ভাই লক্ষ্মণকে চোদ্দো বছরের জন্য নির্বাসনে পাঠানো হয়। উপদ্বীপ অঞ্চলের বনে বনে ঘুরে এঁরা জীবন অতিবাহিত করতে থাকেন। ইতিমধ্যে লঙ্কা (সিংহল বা শ্রীলঙ্কা)-র রাজা রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে যান। এর পরের ইতিহাস হল সীতাকে উদ্ধারের জন্য হনুমানের সহযোগিতায় রাক্ষসরাজ রাবণের বিরুদ্ধে রামের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে শেষ- পর্যন্ত রাম জয়ী হন ও সীতাকে উদ্ধার করেন। এরপর অগ্নিপরীক্ষার দ্বারা সীতা নিষ্পাপ প্রমাণিত হলে রামচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর পুনর্মিলন ঘটে এবং রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা চোদ্দো বছর অতিবাহিত হবার পর কোসল রাজ্যে ফিরে যান। সেখানে রামের রাজ্যাভিষেক হয় এবং গৌরবের সঙ্গে তিনি শাসন পরিচালনা করেন। তাঁর শাসনাধীনে কোসলে এক আদর্শ শাসন গড়ে উঠেছিল, যা আজও 'রামরাজ্য' নামে কল্পিত হয়ে থাকে।
উপরের যে আলোচনায় আমরা পৌছালাম পরিষ্কার হয়ে উঠেছে তা হল রামচন্দ্র রামায়ণ মহাকাব্যের নায়ক এবং মহাকাব্য অনুসারে তিনি অযোধ্যার রাজা দশরথের জ্যেষ্ঠ পুত্র। কিন্তু তাঁর ঐতিহাসিকত্ব নিয়ে গভীর সংশয় আছে। এখনও পর্যন্ত কোনো ইতিহাসবিদ রামচন্দ্রকে ঐতিহাসিক চরিত্রের মর্যাদা দেননি। উল্লেখ্য, মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বিষয়টি যেমন প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের দ্বারা প্রমাণিত, রামায়ণে বর্ণিত রাম-রাবণের যুদ্ধ ও অন্যান্য কাহিনী কিন্তু পুরাতাত্ত্বিক বা অন্য কোন সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত নয়। বলাবাহুল্য, নির্ভরযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ না থাকলে কেবলমাত্র কাব্যে বর্ণিত চরিত্রকে ঐতিহাসিক মর্যাদা দেওয়া যুক্তিসঙ্গত নয়।
•রামায়ণের মূল কিছু তথ্যে আসা যাক:-
রামায়ণ মহাকাব্যটির ঘটনাস্থল উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশে কোশল রাজ্যে। মূল কেন্দ্র অযোধ্যা। যদিও এই মহাকাব্যে বর্ণিত অযোধ্যা এবং বর্তমানকালের অযোধ্যা এক বা অভিন্ন কি না সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। উল্লেখ্য, প্রখ্যাত প্রায় সমস্ত ঐতিহাসিকই স্বীকার করে থাকেন যে, খ্রিঃ পুঃ ষষ্ঠ শতকের আগে ভারতবর্ষের ধারাবাহিক রাজনৈতিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থাদি থেকে ভারতে যে ‘ষোড়শ মহাজনপদ'-এর কথা জানা যায়, তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য জনপদ ছিল কোশল, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল অযোধ্যা। কিন্তু স্মরণে রাখা দরকার যে বৌদ্ধ গ্রন্থ অঙ্গুত্তর নিকায় ও জৈন গ্রন্থ ভগবতীসূত্রে ছয়টি প্রধান নগরের নামোল্লেখ আছে, যার মধ্যে অযোধ্যা অনুপস্থিত। এরকম মনে করা হয়ে থাকে যে সরযূ নদীর তীরে অবস্থিত প্রাচীন সাকেত (জৈন-বৌদ্ধ গ্রন্থে উল্লেখিত এবং কোশল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত) শহরই অযোধ্যা নামে পরিচিত হয়েছে। অনুমান হয় যে মহাকাব্যের অযোধ্যা সাকেতের সঙ্গে মিশে গেলেও যেতে পারে।
•এই মহাকাব্যের প্রধান চরিত্র রামচন্দ্রের নামানুসারেই এর ঐরূপ নামকরণ। মহাভারতের তুলনায় আয়তনের দিক থেকে রামায়ণ অনেক ছোট। উল্লেখ্য, বর্তমানে যে রামায়ণ আমরা দেখতে পাই তার শ্লোকসংখ্যা চব্বিশ হাজার এবং সাতটি ভাগ (কাও)-এ বিভক্ত। প্রসঙ্গত বলা যায়, মহাভারতের ন্যায় রামায়ণের আদিরূপও আমরা দেখার সুযোগ পাইনি। মহাভারতের ন্যায় রামায়ণও লেখা হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে। সাধারণভাবে মনে করা হয় রামায়ণ খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকের মধ্যে রচিত হয়েছিল। অর্থাৎ মহাভারতের রচনাকালের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় এটি আগে শুরু হয়ে পরে শেষ হয় এবং রামায়ণ পরে শুরু হয়ে আগে শেষ হয়। পূর্ণকলেবরে মহাকাব্যের রূপ আগে পায় বলেই সম্ভবত এর নাম হয়েছে আদিকাব্য। রামায়ণ রচনার সঙ্গে মহাকবি বাল্মীকির নাম জড়িত। কিন্তু মনে রাখা দরকার এটি কোনো একক মানুষের কর্মকাণ্ড নয়। কেননা, কোনো একজন ব্যক্তির পক্ষে তো চার-পাঁচশো বছর ধরে কোনো কাব্য রচনা সম্ভব নয়। বলাবাহুল্য, এই মহাকাব্যের মধ্যে বহু প্ৰক্ষিপ্ত অংশ আছে। পণ্ডিতদের অনুমান রামায়ণের সপ্তম কাণ্ড সম্পূর্ণ রূপে এবং প্রথম কাণ্ডের অনেকটাই পরবর্তীকালের সংযোজন।
প্রথমে মহাভারত সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক। সাধারণভাবে মনে করা হয় কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত রচনা করেছিলেন। সাম্প্রতিককালে পণ্ডিতদের গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হল ঐ ধারণা ঠিক নয়। কারণ এই দীর্ঘ মহাকাব্যটি কোনো একজন বিশেষ মানুষ বা কবির জীবনকালের মধ্যে সমাপ্ত হওয়া সম্ভব নয়। মহাকাব্যটি সমগ্র অংশ পাঠ করলে বোঝা যায় যে এটি কোনো একজন কবির লেখা নয়। বহু কবি কয়েক শতক ধরে এটি লিখেছিলেন। তবে বেদব্যাস সেই সমস্ত কবিদের মধ্যে একজন। যাঁরা এটি লিখেছিলেন তাঁদের প্রায় সকলেরই নাম সম্ভবত কালস্রোতে ভেসে গেছে। উল্লেখ্য, মহাভারতের যে আয়তন আমরা বর্তমানে পেয়ে থাকি তার ভিত্তিতে বলা যায় এটি পৃথিবীর দীর্ঘতম কাব্য। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর অন্য সব মহাকাব্যের বহু ঊর্ধ্বে এর স্থান। কেন ঊর্ধ্বে তার উত্তরও আছে মহাভারতে। সেখানে বলা হয়েছে, 'মহাভাবাচ্চ মহাভারতমুচ্যতে' (১/১/২০৯)। এর অর্থ হল মহত্ব ও ভারবত্ত্ব থাকার জন্যই এর নাম মহাভারত। আরো বলা হয়েছে, মহাভারত হল ভারতের কলেবর, সত্য ও অমৃত।
মহাভারতের বিষয়বস্তু ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আলোচনা পরে হবে। আগে এর তারিখ বা সময়কাল সম্পর্কে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যাক। তারিখ নির্ণয়ের বিষয়টি যদিও বিতর্কিত, তথাপি পণ্ডিতেরা সকলেই এই বিষয়ে একমত যে এটি লেখা হয়েছিল সুদীর্ঘকাল ধরে। বেদগুলি যেহেতু মহাভারত সম্পর্কে নীরব সেহেতু মনে হওয়া স্বাভাবিক যে মহাভারতের রচনা কাল বৈদিক যুগ (আঃ ১৫০০ খ্রিঃ পূঃ-৬০০ খ্রিঃ পূঃ)-এর পরে। পণ্ডিতপ্রবর অধ্যাপক উইনটারনিৎস বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে এসেছেন যে খ্রিঃ পূঃ চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের মধ্যে মহাভারত রচিত হয়েছিল। বর্তমান মহাভারতের শ্লোকসংখ্যা এক লক্ষেরও অধিক।
আবার অপর পণ্ডিত এ. এ. ম্যাকডোনেল মহাভারতের রচনাকালকে একটু পূর্ববর্তী বলে মত প্রদান করেছেন। তিনি খ্রিঃ পূঃ পঞ্চম শতক থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের মধ্যে এর সময়কাল নির্দিষ্ট করেছেন। কিন্তু এই মতামতগুলি সবই অনুমান-নির্দিষ্ট করে কিছু বলা শক্ত। একটা কথা অবশ্য বলা সম্ভব যে, মহাভারতে বর্ণিত অন্তত কিছু ঘটনাবলীর সময়কাল ১৪০০ খ্রিঃ পূঃ থেকে ৭০০ খ্রিঃ পূঃ-এর মধ্যে। এই প্রসঙ্গে কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। উল্লেখ্য কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে যুদ্ধ এবং এর সময়কালের বিষয়টি পুরাণ এবং হস্তিনাপুরের ধ্বংসাবশেষের খননকার্য থেকেও কিছুটা অনুমিত হয়। প্রসঙ্গত বলা যায় কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর হস্তিনাপুরের রাজাদের সপ্তম বংশধরের রাজত্বকালে এক বন্যার সৃষ্টি হয়েছিল, এমন কথা বলা হয়েছে পুরাণে। আবার হস্তিনাপুরে খননকার্যের ফলে উৎখননের দ্বিতীয় স্তরে প্রাপ্ত নিদর্শনের সাহায্যে প্রত্নতাত্ত্বিকরা অনুমান করেছেন যে ৮০০ খ্রিঃ পূঃ-এর কাছাকাছি সময়ে গঙ্গার ন্যায় সব ধুয়ে গিয়েছিল। যেহেতু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর বন্যার সৃষ্টি হয়েছিল, সেহেতু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ এর ১০০ বছর আগে সংঘটিত হয়েছিল বিবেচনা করে ৯০০ খ্রিঃ পূঃ ধরা হয়ে থাকে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ওপরে মহাভারতের রচনাকালের যে বিস্তৃত সময়রেখা নির্দিষ্ট হয়েছে তাঁর আগেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল) এইসব দিক থেকে বিচার করে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ঐতিহাসিকত্বকে স্বীকার করে নিতে হয়। আবার একথাও ঠিক যে যদি কুরুক্ষেত্র বা মহাভারতের যুদ্ধের ঐতিহাসিকত্ব আরো বিভিন্ন তথ্য থেকে প্রমাণিত হয়, তাহলে এই মহাকাব্যটিকে ধর্মীয় গ্রন্থ আখ্যা দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
প্রধানত ভৌমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয় নিয়ে কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বেধেছিল। উল্লেখ্য, এই যুদ্ধের বিষয়কে কেন্দ্র করেই মহাভারতের ঘটনা প্রবাহ আবর্তিত হয়েছে এবং এর সূত্র ধরে মহাকাব্যের চরিত্রগুলি বিভিন্ন রূপে উপস্থাপিত করা হয়েছে। অবশ্য এই যুদ্ধ ছাড়াও অন্যান্য নানা কাহিনীও আছে। যাই হোক দিল্লির উত্তরাংশে উর্বর এলাকা হল কুরুক্ষেত্র। মহাভারতে কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে সংঘাতের এক বিস্তৃত বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে, যা এখানে অতি সংক্ষেপে উল্লেখ করা যেতে পারে। ধৃতরাষ্ট্রের একশত পুত্রকে বলা হত কৌরব যাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ছিলেন দুর্যোধন। ধৃতরাষ্ট্রের ভাই পাণ্ডুর ছেলেদের বলা হত পঞ্চপাণ্ডব। কারণ তাঁরা ছিলেন সংখ্যায় পাঁচ। এঁদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ছিলেন যুধিষ্ঠির। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ হওয়ায় তিনি রাজ্য শাসন করার অধিকারী ছিলেন না। পাণ্ডুর ছেলেরাই কুকুর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন। কুরু রাজ্যের রাজধানী ছিল হস্তিনাপুর। পাণ্ডবদের রাজ্য শাসনের অধিকারের বিষয়টিতে কৌরবরা ক্ষুদ্ধ হন এবং পাণ্ডবদের দেশ থেকে বিতাড়নের জন্য নানা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেন। অবস্থা জটিল বুঝে ধৃতরাষ্ট্র রাজ্যকে দ্বিখণ্ডিত করে। একটা অংশ পাণ্ডবদের প্রদান করেন এবং তাদের নতুন রাজধানী হয় ইন্দ্রপ্রস্থ। কিন্তু এত করেও সংঘর্ষ এড়ানো গেল না—শুরু হয় বিখ্যাত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ শুরুর প্রায় তেরো বছর আগে কৌরবদের আহ্বানে পাশা খেলায় যোগদান করে পরাজিত হয়ে পাণ্ডবরা ন্যায়নীতির বশবর্তী হয়ে দেশত্যাগী হন এবং ফিরে এসে নিজেদের রাজ্যাংশ দাবি করলে কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে যুদ্ধ বাধে (আনুমানিক ১০০ খ্রিঃ পূঃ)। এই যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল ১৮ দিন। শেষপর্যন্ত কৌরবদের পরাজয় ঘটে। জয়ী হয়ে পাণ্ডবরা বেশ কিছুকাল সুখে শান্তিতে রাজ্যশাসন করার পর তাঁদের এক পৌত্রের ওপর শাসন পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পণ করে হিমালয়ে মহাপ্রস্থান করেন। এই হল মহাভারত মহাকাব্যের প্রধান কাহিনী।
কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে যুদ্ধ মহাভারতের প্রধান বিষয়বস্তু হলেও এর অসংখ্য শ্লোকে বহু চিরন্তন সত্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। মহাভারতের শান্তিপর্বে যুধিষ্ঠির বলছেন, 'পাপ করে ফেলে নিজেকে অমানুষ মনে করা উচিত নয় : সূর্য যেমন রাত্রিশেষে উদিত হয়ে অন্ধকারকে বিনষ্ট করে, তেমনই সৎকর্মের দ্বারা দুষ্কর্ম বিনষ্ট করা যায়' (১২/১৪৯/৩১-৩২) ; 'মহাসমুদ্রে যেমন দুটি কাষ্ঠখণ্ড ভাসতে ভাসতে কাছাকাছি আসে, আবার একটু পরে ভাসতে ভাসতে দুদিকে চলে যায়, এই পৃথিবীতে মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগও একই রকম' (১২/২৮/৩৬)। আবার একজায়গায় কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন, 'সাহসের সঙ্গে যারা যুদ্ধে উদ্যত, যারা প্রাণের আশা পুরোপুরি ত্যাগ করেছে, তাদের সামনে দাঁড়াবার সাধ্য স্বয়ং ইন্দ্রদেবেরও নাই।' মহাভারতের দ্রোণপর্বে ধৃতরাষ্ট্রের অনুশোচনা শুনে সঞ্জয় বলেছেন, 'এখন অনুতাপ করে কি লাভ? প্লাবন ভেঙে আসবার পর সেতু বাঁধবার চেষ্টার মতোই নিষ্ফল এ বিলাপ'। এই ধরনের আরো অনেক চিরন্তন সত্য বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে নানা উপমার মাধ্যমে, যা এখানে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন।
বস্তুতপক্ষে, বিষয়-বৈচিত্র্যে মহাভারতের তুলনা মেলা ভার। আগেই আলোচিত হয়েছে যে মহাভারত রচিত হয়েছে দীর্ঘ সময়কাল ধরে। স্বাভাবিকভাবেই ঐ দীর্ঘ 'সময়ের ভারতের এক বৃহত্তর অংশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা-ব্যবস্থা, রাজনীতি, ধর্মীয় জীবনযাত্রা এবং প্রযুক্তিবিদ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য পরিবেশিত হয়েছে এই মহাকাব্যটিতে।
0 Comments