সাহিত্যিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের তুলনামূলক আলোচনা করো

 সাহিত্যিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের তুলনামূলক আলোচনা করো 



প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান সংক্রান্ত বিস্তৃত আলোচনার পর এখন সাহিত্যিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের মধ্যে কিছু সুস্পষ্ট পার্থক্য এবং সেই সঙ্গে সাহিত্যিক উপাদানের দুর্বলতার দিকটি আলোচনা করা যেতে পারে। সাহিত্যিক উপাদান—তা গ্রন্থ বা বিবরণ যাই হোক না কেন, সততই পরিবর্তিত হয়; সুদূর প্রাচীনকালে লিখিত গ্রন্থটি পরবর্তীকালে মুদ্রণের সময় কিছু পরিবর্তন ঘটে। অনেক সময় মূল গ্রন্থটি পাওয়া যায় না ; এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদের সময় অনুবাদক তাঁর ইচ্ছামত এতে পরিবর্তন ঘটান। এর ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃত বিবরণ বা ঘটনা বিকৃত হয়। শুধু তাই নয়, সমকালীন পর্যটক বা লেখক যে দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি লিখেছেন, পরবর্তীকালে তাঁর চিন্তাধারার সঠিক প্রয়োগ নাও হতে পারে। সাহিত্যগত বর্ণনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবস্থাপন্ন মানুষের কথাই স্থান পেয়েছে; ফলে এর থেকে সমাজের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখা যায় না। সাহিত্যিক উপাদানের অন্তর্ভুক্ত নাটক বা কাব্যে কাল্পনিক ঘটনার সংমিশ্রণ থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই এগুলি কখনো সত্যিকারের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসের মর্যাদা পেতে পারে না। যে সমস্ত সভাকবি সংশ্লিষ্ট শাসকের সভা অলংকৃত করে থাকতেন তাঁদের লিখিত গ্রন্থ বা বিবরণ থেকে প্রকৃত তথ্য উদ্‌ঘাটন করা অনেক সময় অসম্ভব হয়ে ওঠে। কারণ, তাঁদের লেখা সাধারণত শাসকের প্রতি পক্ষপাতদোষে দুষ্ট থাকে। সর্বোপরি, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য রচয়িতাদের অতিশয় আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি অনেক সময় প্রকৃত ইতিহাস জানার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।


বৈদেশিক পর্যটকদের লিখিত বিবরণ ইতিহাস রচনার কাজে বেশ সমস্যার সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে দু'ধরনের ত্রুটি প্রায়শই লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত, ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করতে এসে অল্প কয়েক বছর আবার কখনো মাত্র কয়েক মাস এখানে থেকে ভ্রমণকারীদের পক্ষে এদেশের সামগ্রিক বিষয় জানা সম্ভব নয়। ফলে লোক-কাহিনীর ওপর তাঁদের অনেক সময় নির্ভরশীল হতে হয়। লোককাহিনীর ভিত্তিতে লিখিত বিবরণ কখনই নির্ভেজাল হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, যে শাসকের রাজত্বকালে কোনো পর্যটক এদেশে এসেছিলেন তাঁর বা তাঁদের বিবরণীতে সংশ্লিষ্ট শাসকের গুণগানের কথা বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। এটা খুবই বাস্তব ও স্বাভাবিক। অপরদিকে সেই শাসকের বিরোধী শক্তি সম্পর্কে পর্যটকদের বিবরণে বিষোদ্‌গার ফুটে উঠেছে। উপরিউক্ত দুটি বিষয় ছাড়াও সাহিত্যিক উপাদানের আরো একটি বড় ত্রুটি হল বৈদেশিক পর্যটকদের বিবরণে অথবা দেশীয় বা বিদেশীয় কোনো গ্রন্থে কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা এলাকার কথাই আলোচিত হয়েছে; সেগুলি থেকে সমগ্র ভারতের অবস্থা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করা সম্ভব নয়।


এছাড়া, বিদেশী লেখকগণ তাঁদের লিখিত বর্ণনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজ দেশের পরিস্থিতির আলোকে ভারতীয় সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ মেগাস্থিনিসের ‘ইন্ডিকা'য় ভারতে দাসপ্রথার প্রসঙ্গটি উপস্থাপন করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, ঐ গ্রন্থে মেগাস্থিনিস লিখেছেন যে, ভারতীয়দের মধ্যে একজনও ক্রীতদাস নেই। অথচ ভারতীয় সাহিত্যে এর অস্তিত্বের কথা জানা যায়। আসলে মেগাস্থিনিস ইউরোপের দৃষ্টিকোণ থেকে ঐ বিষয়টিকে দেখতে গিয়ে এই ধরনের মন্তব্য করেছেন। এর ফলে ঐতিহাসিক সত্যের কখনো কখনো বিকৃতি ঘটার সম্ভাবনা থাকে।


সাহিত্যিক উপাদানের দুর্বলতার দিকগুলি এতক্ষণ আলোচনা করা হল। এখন সাহিত্যিক উপদানের তুলনায় প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান কোন্ দিক থেকে শ্রেষ্ঠ তা বোঝা দরকার। প্রথমত, সাহিত্যিক উপাদানে যুগে যুগে পরিবর্তন আসে। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান প্রাকৃতিক কারণে নষ্ট হওয়া বা ভেঙে যাওয়া ছাড়া অপরিবর্তিত থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যাদুঘরে প্রাচীনকালের যে অসংখ্য মুদ্রারাজি, লেখ ও স্থাপত্য- ভাস্কর্যের নিদর্শন রক্ষিত আছে, সেগুলি যুগ যুগ ধরে একই অবস্থায় রয়েছে এবং থাকবে। তবে পার্থক্য হল এই যে, এগুলি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। ঐতিহাসিকেরা নিজ নিজ রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী রক্ষিত ঐ সমস্ত বস্তুরাজির ভিত্তিতে প্রাচীন ইতিহাসের সৌধ নির্মাণ করেন। দ্বিতীয়ত, প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান সাধারণত ভুল তথ্য পরিবেশন করে না। সাহিত্যিক উপাদানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যে অতিরঞ্জন থাকে এগুলি তা থেকে মুক্ত। প্রশস্তিগুলিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু অতিশয়োক্তি থাকে বলে মনে হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলিতে উল্লেখিত প্রাসঙ্গিক নানা তথ্য নির্ভুল থাকে। তৃতীয়ত, খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত বিভিন্ন বস্তু, যথা— দেবদেবীর মূর্তি, মাটির পাত্র, খাদ্যশস্য, ঘরবাড়ি প্রভৃতি সমাজ ও সংস্কৃতির যে ধরনের নিদর্শন তুলে ধরে সাহিত্যিক উপাদান সে-বিষয়ে অপারগ। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই।

Post a Comment

0 Comments