**চর্যাপদের সাহিত্য মূল্য বা কাব্যিক মূল্য আলোচনা করো।
কাব্যিক মূল্য ও সাহিত্যিক মূল্যে যাবার আগে কিছু তথ্য জানা আবশ্যক এই চর্যাপদের পুঁথি টি কোথা থেকে আবিষ্কার হয়েছিল এবং কত সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল সেটি কিন্তু জানা আবশ্যক।
•ভূমিকা:-
বাংলা সাহিত্যের আদি যুগের নিদর্শন চর্যাপদ। মোহামহোপাধ্যায় পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজ দরবার থেকে ১৯০৭ সালে চর্যাপদের প্রতিটি প্রকাশিত হয়। ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে এই চর্যাপদ পুঁথি টি প্রকাশিত হয় অর্থাৎ বলা বাহুল্য যে হাজার বছরের পুরান বাংলা ভাষায় বৈধ গান ও দোহা নামে এটি পরিচিত।
সাহিত্য হল জীবনবেদ। মানব জীবনের বিচিত্র সুখ-দুঃখ, আশা- নিরাশার কাহিনী নিয়ে সাহিত্য গড়ে ওঠে। চর্যাগীতি সিদ্ধাচার্যদের গুহ্য সাধনমূলক কবিতা। এর ভাষার নাম সন্ধ্যা অর্থাৎ প্রহেলিকাময় সাংকেতিক ভাষা। শব্দগুলি দ্ব্যর্থবোধক দেহ সাধনার গুহ্যতত্ত্ব চর্যার সব পদে প্রকাশিত। সিদ্ধাচার্যরা আধিব্যাধি, জন্ম-মৃত্যু ও সুখ-দুঃখের ঊর্ধ্বে মহাসুখ লাভ করতে চেয়েছে দেহ সাধনার মাধ্যমে। তবে সাহিত্যিক দিকটি আমাদের বিচার্য।
•ধর্ম ও সাহিত্য :-
পৃথিবীর আদিযুগের সাহিত্য ধর্মকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে। বাইবেল, বেদ, উপনিষদ ও পুরাণে ধর্মভাব প্রবল। শুধু বেদ-উপনিষদ-পুরাণ নয়, বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগে রচিত বৈষ্ণব পদাবলী ও শাক্ত পদাবলী ধর্মকেন্দ্রিক। চর্যাগীতি সাধন বিষয়ক রচনা হলেও মানবজীবনের সুখ-দুঃখের ভিত্তিতেই তার প্রতিষ্ঠা।চর্যাকারেরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপরসগন্ধময় জগৎকে ও মানবজীবনের সুখদুঃখ মিলন-বিরহের লীলা বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করেন নি। রূপ ও অরূপ জগৎ চর্যাগীতিতে একাকার হয়ে গেছে। ধর্মতত্ত্ব রূপ থেকে অরূপের দিকে যাত্রা করে। চর্যাপদ রচয়িতারা ধর্মতত্ত্বের কথা বলতে গিয়ে সাধারণ মানুষের সমাজজীবনের থেকে প্রতীক ও চিত্রকল্পাদি গ্রহণ করেছেন।
•অলংকার:-
এখানে কিছু ছন্দের মাধ্যমে জানানো যেতে পারে যে- অলংকার শাস্ত্রের বিধি-বিধান অনুসারে কবিগণ শ্লেষ, যমক, উৎপ্রেক্ষা, উপমা, রূপকাদি অলংকারের প্রয়োগ করেছেন। যেমন—
“কা আ তরুবর পঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চীএ পইঠো কাল।।” (১ নং চর্যা)
চর্যাপদে যে ক'টি নৌযাত্রার চিত্র আছে সরকটিতে উৎপ্রেক্ষা অলংকারের প্রকাশ রয়েছে। সাধকের চিত্ত একখানি নৌকা। নৌকা চালনার বর্ণনাচ্ছলে কবিরা মহাসুখরূপ সমুদ্র গমনের ইঙ্গিত করেছেন। এছাড়া অতিশয়োক্তি, বিরোধাভাস, অসঙ্গতি, অনুপ্রাস অলংকারের প্রচুর দৃষ্টান্ত বর্তমান।
•জীবন বোধ ও রূপ চেতনা:-
চর্যাপদে সূক্ষ্মবুদ্ধি ও তত্ত্বকথার আবেদন প্রাধান্য পেয়েছে। বৈষ্ণব পদাবলীতে রাধাকৃষ্ণের জীবাত্মা-পরমাত্মার প্রেমবিরহের কাব্যরস প্রতিবিম্বিত। চর্যাপদেও নরনারীর বিচিত্র কাহিনী ইড়া-পিঙ্গলা সুষুম্না ও সহজানন্দনতত্ত্ব স্পষ্টভাবে চিত্রিত। এখানে বাংলাদেশের গাছপালা, নদ-নদী, খালবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব শিল্পরূপ লাভ করেছে।
**উপসংহার:-
সর্বোপরি বলা যায় যে চর্যাপদের সাহিত্যমূল্য অপরিসীম। সামাজিক রাষ্ট্রিক চিত্র ও ধর্ম বিবর্তনের আধ্যাত্ম্য সংগীতি চর্যাপদের মূল বিষয় নয় কিন্তু এর সাহিত্য মুল্য পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে।
0 Comments