•প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে সাহিত্যিক উপাদান হিসেবে দেশীয় ও বৈদিক সাহিত্যে উপাদান সম্পর্কে আলোচনা করো।
সাহিত্যিক উপাদান
•দেশীয়
প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যগত উপাদান খুবই কম। সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের জীবনধারা বোঝার জন্য সাহিত্যিক উপাদান রয়েছে। সাবধানতার সঙ্গে সেগুলি ব্যবহার করে ঐতিহাসিকেরা ইতিহাস রচনা করে থাকেন। তবে মনে রাখা দরকার যে, আমাদের দেশের ধারাবাহিক ইতিহাস জানার জন্য কেবল সাহিত্যিক প্রমাণের ওপর নির্ভর করা নিরাপদ নয় ৷ এখানে আরো একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এই পর্বে আঃ খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ব্যবহাত সাহিত্যিক উপাদান আলোচিত হয়েছে। পরবর্তী উপাদানগুলি বিশ্লেষিত হয়েছে এই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে।
•বৈদিক সাহিত্য
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর আগের ইতিহাস জানার জন্য বেদ তথা বৈদিক সাহিত্যের ওপর আমরা পুরোপুরি নির্ভর করে থাকি। বৈদিক সাহিত্য বলতে ঋক, সাম, যজু, অথর্ব- এই চারটি বেদ ছাড়াও ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, সূত্র সাহিত্য ও উপনিষদকে বোঝায়। চারটি বেদের মধ্যে ঋগ্বেদ সংহিতা প্রাচীন। (এরকম বলা হয়ে থাকে যে ঋগবেদকে সঙ্গে নিয়ে আমরা ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক যুগে প্রবেশ করেছি। ঋগ্বেদ রচনার সময়কাল নিয়ে পণ্ডিত মহলে নানা মতামত বিরাজমান। তবে সাধারণভাবে মনে করা হয় এর আনুমানিক সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে। ঋগ্বেদে প্রধানত প্রার্থনার মন্ত্র সন্নিবেশিত হয়েছে। পরবর্তী বেদ ও উপনিষদগুলি সম্ভবত রচিত হয়েছিল ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে। সুতরাং উভয় ধরনের বেদের মধ্যে বেশ কয়েকশো বছরের ব্যবধান রয়েছে। পরবর্তীকালে রচিত এই বেনগুলিতে প্রার্থনা-বিষয়ক বর্ণনা ছাড়াও বিভিন্ন উৎসব এবং বহু কাল্পনিক কাহিনীও লিপিবদ্ধ আছে। উপনিষদগুলিতে প্রধানত দার্শনিক বিষয়বস্তু উপস্থাপিত হয়েছে। প্রসঙ্গত বলা যায় দীর্ঘ পরম্পরা ধরে বেদগুলি আরো স্পষ্ট করে বললে বেদের শিক্ষাগুলি গুরু থেকে শিষ্যের মধ্যে মুখে মুখে প্রচারিত হত। তখন তা লিখিত রূপ পায়নি। এই কারণেই বেদের আর এক নাম শ্রুতি।
•ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবে বেদ তথা বৈদিক সাহিত্যের মূল্য নিরূপণের বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কিছু বাদবিতণ্ডা রয়েছে। এতদসত্ত্বেও প্রাচীন ভারতের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, এমনকি রাষ্ট্র বিষয়ক অনেক মূল্যবান তথ্য বোগুলিতে আছে। বৈদিক সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এগুলি কেবল ঘটনার বর্ণনাকারী হিসাবেই প্রতিভাত হয়নি, অনেক ঘটনাক্রমিক তথ্য এগুলির মধ্যে উপস্থাপিত হয়েছে। বহু প্রথিতযশা ঐতিহাসিক ভারতীয় ইতিহাস দর্শনের বিবর্তনে বেদের গুরুত্বপূর্ণ স্থানের কথা উল্লেখ করেছেন। এস. এন. প্রধান এমনও মন্তব্য করেছেন যে, ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বৈদিক সাহিত্য যথেষ্ট কৃতিত্বের দাবিদার। বস্তুত, প্রায় হাজার বছরের ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বহু মূল্যবান তথ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে বৈদিক সাহিত্যে।
•কিন্তু এফ. ই. পার্জিটারের মতো পণ্ডিত এগুলির মধ্যে ঐতিহাসিকবোধের অভাব লক্ষ করেছেন। বেদের ওপর নির্ভর করে ইতিহাস রচনা কতখানি বিশ্বাসযোগ্য সে-বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে, ইতিহাস রচনায় বৈদিক সাহিত্য অপরিহার্য। কোগুলির পরিশিষ্ট হিসাবে ব্রাহ্মণসমূহ এবং ব্রাহ্মণগুলির পরিশিষ্ট হিসাবে আরণ্যক ও উপনিষদগুলিকে ধরে নেওয়া হয়। এগুলিতে প্রাচীন কিছু ঐতিহ্য, যথা— যাগযজ্ঞ, আচার-অনুষ্ঠান প্রভৃতি বিধৃত থাকায় কোনো কোনো সময় এগুলি ইতিহাস রচনার কাজে ব্যবহার করা হয়। যেহেতু বৈদিক সাহিত্য ছাড়া সে-যুগের কোনো ইতিহাস আমরা জানতে পারি না, সেহেতু সমকালীন ইতিহাস রচনার কাজে এগুলি অপরিহার্য।
0 Comments