প্রাচীন ভারতের উপাদান হিসেবে স্থাপিত ও ভাস্কর্যের ভূমিকা আলোচনা করো। স্থাপিত ও ভাস্কর্য

 •ভূমিকা:-

স্থাপিত ও ভাস্কর্য প্রাচীন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রচনার জন্য ঐতিহাসিক রা তাদের গবেষণার মাধ্যমে তারা তাদের মত ব্যক্ত করেছেন। দেশের সভ্যতা সংস্কৃতির মান বুঝতে এ ধরনের উপাদান অপরিহার্য।প্রাচীনকালের মানুষ তাদের অসংখ্য স্থাপিত ও ভাস্কর্যের নিদর্শন রেখে গেছেন সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।


স্থাপিত ও ভাস্কর্য:-  

মাটির তলা থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্নবস্তু, যথা—মৃৎপাত্র তথা টেরাকোটার নিদর্শনসমূহ, পাথর অথবা অন্য কোনো ধাতব মূৰ্ত্তি এবং স্থাপত্য-ভাস্কর্যের নানা নিদর্শন প্রভৃতি হল বাস্তবভিত্তিক উপাদান। কেননা, এই সকল উপাদানগুলিতে কোনো ধরনের ভেজাল দেওয়া যায় না কিংবা বলা যেতে পারে এগুলির মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা থাকে না। সাহিত্যগত তথ্যগুলি ব্যবহারের সময় যেমন বিশেষ সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজন হয় প্রত্নবস্তুগুলির ক্ষেত্রে সে ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করতে হয় না। এই ধরনের উপাদানের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল এই যে, ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে মাটির টিলা বা ঢিবির তলায় যে সমস্ত অসংখ্য প্রত্নবস্তু রয়েছে, খননকার্যের ফলে সেই সমস্ত তথ্যগুলি একেবারে অবিকল অবস্থায় আমাদের হাতে আসে। এর ভিত্তিতে প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকদের সমন্বয়ে উন্মোচিত হয় ইতিহাসের নতুন দিগন্ত। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ইতিপূর্বে খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত তথ্যাদি ছাড়াও সাম্প্রতিককালে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বেড়াটাপার চন্দ্রকেতুগড় এবং বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটে খননকার্যের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যাদি উক্ত ধারণার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বস্তুত, বাংলার ইতিহাস রচনায় ঐ দুই অঞ্চলের প্রত্নসম্পদকে এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এখানে উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় হবে যে খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত সময়কালের অসংখ্য মৃৎপাত্র ও ভাস্কর্য নিদর্শন পাওয়া গেছে চন্দ্রকেতুগড়ে যেগুলি ঐ অঞ্চল তথা বাংলার সামগ্রিক ইতিহাস রচনার মূল্যবান উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে।



•এছাড়াও ইতিহাসের এমন অনেক বিষয় আছে যেগুলি কেবলমাত্র খননকার্যের ফলেই জানা সম্ভব হয়েছে। এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হল হরপ্পা সভ্যতা। হরপ্পা সভ্যতা যে নগরকেন্দ্রিক ছিল, সুদূর প্রাচীনকালে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় ভারতবর্ষেও যে উন্নতমানের সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তা হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, লোথাল, ধোলাবিরা (গুজরাট), কালিবঙ্গান (রাজস্থান) প্রভৃতি অঞ্চলে খননকার্যের ফলে জানা সম্ভব হয়েছে। বস্তুত, প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের সাহায্যেই নগরায়ণ সংক্রান্ত আলোচনা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। শুধু হরপ্পা সভ্যতার ক্ষেত্রেই যে একথা প্রযোজ্য তা নয়, তক্ষশিলা, সারনাথ অথবা রাজগীর প্রভৃতির ক্ষেত্রেও একথা সত্য। খননকার্যের ফলে যে ইতিহাসের নতুন দিকের সন্ধান মেলে তার দু-একটি উদাহরণ রাখা যেতে পারে। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ ও এপ্রিল মাসে যথাক্রমে পশ্চিম বাংলার দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার গোসাবা থানায় এবং মধ্যপ্রদেশের সাঁচী-সাতধারা এলাকায় নতুন আবিষ্কারের কথাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বন ও পরিবেশ দফতরের কর্মীরা গোসাবা থানা এলাকায় ব্যাঘ্র প্রকল্পের অধীন সংরক্ষিত বনাঞ্চলে মাটি খুঁড়তে গিয়ে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়—(ক)একটি সূর্যমূর্তি,(খ)পবিত্র পদচিহ্নের অনুকৃতি,(গ)গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের ‘শ্রী বিক্রম” স্বর্ণমুদ্রা। উল্লেখ্য যে, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মে সুপ্রচলিত পবিত্র পদচিহ্নের উপাসনার নিদর্শন এবং গুপ্ত সম্রাটের ঐ ধরনের স্বর্ণমুদ্রা এই অঞ্চলে এর আগে বিশেষ পাওয়া যায়নি।

উপসংহার,

শুধু ভারতবর্ষ নয়, ভারতবর্ষের বাইরে খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুগুলিও ভারতীয় উপনিবেশগুলি সম্পর্কে বহু অজানা অধ্যায়ের গ্রন্থিমোচন ঘটিয়েছে। উদাহরণ- স্বরূপ বলা যায়, কাম্বোডিয়ার আঙ্কোরভাট মন্দির এবং জাভার বরবদুরে বৌদ্ধ মন্দিরগুলি প্রাচীন ভারতীয়দের ঔপনিবেশিক ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপের চরমতম নিদর্শন বহন করে আসছে। এছাড়া বালুচিস্তানে খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত প্রস বস্তুর ভিত্তিতে অনুমান করা সম্ভব হয়েছে যে, প্রাচীনকালে ঐ সমস্ত অঞ্চলের সঙ্গে ভারতবর্ষের একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল। সাম্প্রতিককালে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের উদ্যোগে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যে সমস্ত খননকার্য চলছে, এই ধারা যদি অবাহত থাকে তাহলে আশা করা যায় যে, ভবিষ্যতে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অনেক বাড়বে। এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, আর্থ- সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত করলেও রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি এগুলি ততটা নিতে পারে না, যতটা পারে লেখমালা।



Post a Comment

0 Comments